‘তুমি আমার এমনই একজন’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপার জন্মদিন আজ। ১৯৯৩ সাল থেকে নিয়মিত গান শুরু করেন তিনি। তার পর থেকে শুধু সামনেই এগিয়েছেন। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে জনপ্রিয় গানের এই শিল্পীর যেমন আছে প্রাপ্তি, তেমনি এখনো রয়ে গেছে অপূর্ণ ইচ্ছাও। গায়িকা থেকে লেখক হয়ে ওঠাসহ নানা বিষয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে।
শুভ জন্মদিন! দিনটি কেমন কাটছে?
ধন্যবাদ। আমি তো কখনোই বিশেষ কিছু করি না। কিন্তু ভক্তদের ভালোবাসায় দিনটা বিশেষ হয়ে যায়। কাল থেকে ফুল আসা শুরু হয়েছে। প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে উপহার আসা শুরু হয়েছে। আমি সবাইকে বলি কোনো কিছু না দিতে। সেটা তাঁরা নিজেদের পরিবারের কাউকে দিলেই আমি খুশি। টাকা খরচ করতে নিষেধ করি। এমনিতেই এখন মানুষের খরচ বাড়ছে। কিন্তু তাঁরা কেউ কথা শোনেন না। ভালোবাসা হিসেবে গ্রহণ করি। তবে এবার বেশ অবাক হয়েছি। অনেক হাতে লেখা চিঠি পাচ্ছি।
ভক্তরা আপনাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে জন্মদিনের শুভকামনা জানান, এবার চিঠি পাচ্ছেন—পড়ে দেখার সময় হয়?
আমি মেসেঞ্জারে হাজার হাজার শুভেচ্ছাবার্তা পাই। সেগুলো শুধু সিন করা, লাইক ও ধন্যবাদ দিয়েই শেষ নয়; তাঁদের জন্য পরামর্শ বা শুভকামনা জানিয়ে রিপ্লাই দিই। ভক্তদের ভালোবাসার রিপ্লাই দিতে দিতে দুই-তিন মাস সময় লেগে যায়। ক্লান্ত হলেও আমার স্বামী আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহ দেয়। এবার অনেক চিঠিও পেয়েছি। বেশির ভাগেরই ঠিকানা দেওয়া নেই। হয়তো এগুলোর উত্তর দেওয়া হবে না।
কদিন আগে অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন...
এবার ১৩ বছর পর জন্মদিনে দেশে আছি, মেয়ের বাসায়। মেয়ের আবদার, মা এবার শুধুই তার। ফোন দিয়েই বলল, ‘আমি কখনোই বলিনি তুমি শুধু আমার ও ভাইয়ার মা। তুমি সবার মা। এবার জন্মদিনে আমার কাছে থাকবে।’ মেয়ে স্থায়ীভাবে অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গেই রাতে কেক কাটা হয়েছে। ভালোই সময় কাটছে। পরিচিত অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলছি। দেখা হচ্ছে। ভালো সময় কাটছে।
আপনি নিয়মিত ফেসবুকে সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করেন। এই লেখা থেকে ‘সেই পথে যাই’ নামে বই বের হয়েছে। লেখালেখির প্রেরণা কোথায় পেলেন?
শৈশব থেকে মা ডায়েরি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রতিদিন যা হয়, সেটা লিখে রাখো। যা মন চায় লিখো।’ মা বকা দিল, মায়ের ওপর অভিমান, সেটা ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। এভাবেই গান শুরু করার আগেই লেখার অভ্যাস শুরু হয়েছে। আর দৈনিকে লেখার জন্য সাহস জুগিয়েছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ভাই। তিনি আমাকে ফোন দিয়ে লিখতে বলতেন। আমি কী লিখব, জানি না। কিন্তু তিনি নিজের মতো করে লিখতে বলতেন। কখনো মাদক নিয়ে, কখনো রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে লিখতে বাধ্য করতেন। পরে দেখতাম, এমন সব গুণী মানুষের সঙ্গে লেখাগুলো বেরিয়েছে, দেখে অভিভূত হয়ে যেতাম। আর আমার প্রথম বই ‘ছবির যাযাবর’ লিখতে সহায়তা করেছেন ইমদাদুল হক মিলন।
পরিবার থেকে লেখালেখিতে কে বেশি উৎসাহ দেন?
খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার, আমার স্বামী আমার বই পড়ে না, কিন্তু উৎসাহ দেয়। সে আমার লেখা একটাও পড়ে না, কিন্তু উৎসাহ দেয় (হাসি)। বইতে আমি লিখেছি, সে আমার জীবনসঙ্গী, আমার ওস্তাদ, আমরা বন্ধু, সহকর্মী হিসেবে একসঙ্গে থাকি। তার নানান দোষত্রুটি রয়েছে। সেগুলো পড়লে আমার সঙ্গে ঝগড়া লাগবে। এ জন্য পড়ে না। ভালো বলতে পারাটাই তার প্রশান্তি।
দীর্ঘদিন আপনার নতুন গান নেই, গান থেকে দূরে কেন?
নিজে বিনিয়োগ করে আমি কখনোই গান করিনি। আমি একজন কণ্ঠশ্রমিক। আমাকে সংগীত পরিচালকেরা ডাকেন। আমি গান করি। আগে যাঁদের সঙ্গে গান করেছি, তাঁরা অনেকেই এখন আর নেই। জুনিয়র যাদের সঙ্গে গান করি, তারাও আগের মতো গান করে না। করলেও নতুনদের নিয়ে করে। আমি বিশ্বাস করি, সবার একটা সময় থাকে। আমি সেই সময় পার করে ফেলেছি। নতুনেরা আমাকে দিয়ে গান করাতে চায়, কিন্তু মনের ভেতর থেকে উৎসাহ পাই না। কদিন আগে একটি গান করতে গিয়ে পরে রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে বের হয়ে আসি।
রেকর্ডিং শেষ না করেই চলে এসেছিলেন?
কোনো একজন সুরকার বললেন, ভোকর্ড (অটো টিউন) ছাড়া গান রেকর্ডই করবে না। আমি কেন সাউন্ড ইফেক্ট দিয়ে গান গাইব? সে আমাকে বোঝাল, যেহেতু ভোকর্ড আছে, সেটা ব্যবহার করি। অন্য রকম হবে। আমি রাজি হইনি। আমার কণ্ঠের তো তাহলে কোনো দরকার নেই বলেই বাধ্য হয়েই অর্ধেক গান শেষ করে বেরিয়ে এসেছিলাম। সেই প্রযুক্তির সাহায্যে যে কেউই তো গাইতে পারে, তাহলে আমি কেন? এসব কারণেই এখন অনেক গান শুনলে মনে হয়, কয়েকটি জিঙ্গেল একসঙ্গে বাজছে। তবে নতুনেরা যে ভালো করছে না, তা কিন্তু নয়।
কখনো কি মনে হয়, পেশাদারত্ব আগের মতো নেই?
যারা নতুন, তারা কিন্তু আমার এ কথা বিশ্বাস করবে না। তারা তো ভালো করছে। কিন্তু তাদের কাছে আমার প্রত্যাশা কি দিন দিন বেশি হবে না? তা ছাড়া এখন তো আমি যা তা গাইব না। কানে লাগার মতো গান যদি না গাই, তাহলে শ্রোতা আমারই দোষ ধরে বলবেন, এত ভালো গান করতেন কনকচাঁপা, এখন কী গান গাইলেন! শিল্পীদের অবসর হয় না, কিন্তু জানা উচিত, কোথায় থামা দরকার। কেউ যেন না বলে, কী সুন্দর গলা, কী হয়ে গেছে। এই বিষয়েও আমি খেয়াল রাখি। আর আমার মনে হয়, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গান করে ফেলেছি।
নিজেকে কতটা সৌভাগ্যবান মনে করেন?
আমি সৌভাগ্যবান। গানের নেশাটাকে পেশা করতে পেরেছি। দেখা যায়, কেউ কারুকাজ করতে চান, কিন্তু হয়ে আছেন অঙ্কের শিক্ষক। এর চেয়ে দুঃখের কিছু নেই। আমি যা পারি, ভালো লাগে, সেই পথেই আছি। এটাই আমার শান্তি।
গান নিয়ে আপনার কোনো অপূর্ণ ইচ্ছা আছে?
দুই দিন আগে আমি ও আমার স্বামী একজন ব্যস্ত চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম, ডাক্তার আস্তে আস্তে রবীন্দ্রসংগীত শুনছেন। চোখ দেখার পাশাপাশি তিনি গান নিয়ে নানা কথা বলছেন। গানের কথার অর্থ কী, সেগুলো আধ্যাত্মিকভাবে বলতে থাকলেন। তাঁর অনেক জানাশোনা বলেই হয়তো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছিলেন। এমন কিছু ক্ল্যাসিক্যাল গান আমি করতে চাই। যদিও এমন উঁচুমানের গান ও শ্রোতা অনেক কম।
সিনেমায় আপনার অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে, সেগুলোতে দেশের জনপ্রিয় নায়িকারা ঠোঁট মিলিয়েছেন। সিনেমা দেখার সময় তাঁদের মধ্যে কার ঠোঁট মেলানোর সঙ্গে অভিব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ইমোশনাল করেছে আপনাকে?
আমার গানের সঙ্গে শাবনূরের এত সুন্দর ঠোঁট মেলানো, মনেই হতো না আমি গানটি গেয়েছি। আমার গানগুলোতে শাবনূরের ঠোঁট মেলানো অভিব্যক্তি দেখলে মনে হতো, সে নিজেই গাইছে। স্বীকৃতি আমার কতটুকু শাবনূরের কতটুকু, ভাবিনি। ‘ভালোবাসা থাকো তুমি দূরে’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’সহ অনেক গানে শাবনূরের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মৌসুমীসহ অন্যরাও ভালো করত। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি গানে ঠোঁট মিলিয়েছে শাবনূর। মানুষ হিসেবে আমি এমনিতেই ইমোশনাল। আমার গানে শাবনূর আমাকে ইমোশনাল করেছে। শাবনূর, কনকচাঁপা দুই দেহ এক প্রাণ। শাবনূরের জনপ্রিয়তার কোনো মাপকাঠি নেই। তাকে দিয়ে আরও কাজ করিয়ে নেওয়া যেত।