৪০০ বছর আগের লোকগল্প পর্দায় এনে প্রশংসা পাচ্ছেন পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম। ঈদে মুক্তি পেয়েছে এই নির্মাতার কাজলরেখা। সিনেমাটি আরও বড় পরিসরে মুক্তির পরিকল্পনা করছেন তাঁরা। সিনেমার মুক্তি ও নানা প্রসঙ্গে এই পরিচালকের সঙ্গে কথা বলেছেন মনজুরুল আলম
‘কাজলরেখা’ আপনার ক্যারিয়ারে কী প্রাপ্তি যোগ করল?
গিয়াসউদ্দিন সেলিম: দর্শক যাঁরাই সিনেমাটি দেখছেন, তাঁরাই কথা বলছেন। ঈদের পর আমি ঢাকার সব সিনেমা হলে গিয়েছি। সরাসরি দর্শকদের সঙ্গে কথা বলেছি। দর্শক সিনেমাটি দেখে আপ্লুত। দর্শক ৪০০ বছর আগে ফিরে যাচ্ছেন। সিনেমাটি নিয়ে সব প্রজন্মের দর্শকদের মনে অনেক প্রশ্ন। তাঁরা রোমাঞ্চিত। এটাই চেয়েছিলাম।
দর্শকদের সঙ্গে সিনেমা নিয়ে কী কথা হয়েছে?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: আমি সীমান্ত, এসকে টাওয়ার, সিনেপ্লেক্সসহ সব জায়গায়ই গিয়েছি। হল থেকে বের হয়ে দর্শকেরা ঘিরে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, সিনেমাটি সুন্দর। সিনেমাটিতে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মৈমনসিংহ গীতিকার দারুণ একটি উপস্থাপনা তাঁরা পর্দায় দেখেছেন। সিনেমার লোকেশন, সেই সময়, অভিনয় নিয়েই তাঁরা বেশি প্রশ্ন করেছেন। তাঁদের অনেক সূক্ষ্ম বিষয় নিয়ে প্রশ্ন, যেমন সেই সময়ের ভাষা, বাচনভঙ্গি, ইমোশন, সিনেমাটির জন্য আমি রাজার যে বাড়ি তৈরি করেছিলাম, সেগুলোও তাঁদের চোখে পড়েছে। এত ডিটেইলে তাঁরা কথা বলেছেন, যেগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে।
সিনেমাটির ফেসবুক পেজে দেশের নানা প্রান্ত থেকে দর্শকেরা জানতে চাইছেন, তাঁদের জেলায় কবে সিনেমাটি মুক্তি পাবে?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: দর্শকদের আগ্রহ বুঝতে পারছি। আমরা পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলার সিঙ্গেল স্ক্রিনে মুক্তি দেব। এটা আগামী সপ্তাহেই শুরু হতে পারে। ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে সেভাবেই কথা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করব সিনেমাটি দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে।
ঈদে ১১টি সিনেমার ভিড়ে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি ঠিক মনে হয়েছে?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: আমাদের মূল পরিকল্পনা ছিল পয়লা বৈশাখ ঘিরে। জাতীয়তাবোধের জায়গা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া। এখন ঈদ ও বৈশাখ একসঙ্গে পড়ে যাওয়ায় আমরা কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। একসঙ্গে না হলে হয়তো হলসংখ্যা বেশি পেতাম। ঈদের কারণে এখানে একটা প্রভাব পড়েছে। ঈদের পর আমরা বড় পরিসরে যাব।
দর্শকেরা বলছেন, সিনেমার উপস্থাপনায় আপনার নিজস্বতা পাওয়া যায়...
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: পালাগান, জারিগান, আমাদের লোককথা—এগুলো দিয়েই কিন্তু আমরা। এর মধ্য দিয়েই আমরা জানতে পারি, ৪০০ বছর আগে কেমন ছিলাম। সেই প্রভাব আমি সিনেমার মধ্যে রাখতে চেয়েছি। সেই মেজাজই গল্প বলার মধ্য দিয়ে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। আমাদের দর্শক এগুলোই পছন্দ করেছেন। আমি তামিল, তেলেগু, মুম্বাই স্টাইলে গল্প বলতে চাইনি।
কিছু জায়গায় মনে হয়েছে, মূল জায়গা থেকে সরে গেছেন...
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: নাহ্, মূল জায়গা থেকে সরিনি। আমি শত বছর আগের ‘কাজলরেখা’র কাঠামো ঠিক রেখেছি। সেখানে কিছু দৃশ্যে দর্শকদের মধ্যে সাসপেন্স তৈরির জন্য উপস্থাপনায় ভিন্নতা এনেছি। এখন দর্শক বলতে পারেন শেষ দৃশ্যের কথা। সেখানে কেন পরিবর্তন করেছি। এর লজিক আমরা এভাবে ব্যাখ্যা করেছি, আমরা বাঙালি জাতি হিসেবে ক্ষমাশীল, কঠোর হতে পারি না। সেটাই করেছি।
নজর কেড়েছে বিশাল এ আয়োজন। সিনেমাটি নিয়ে প্রথম পরিকল্পনা কত আগের?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: অনেক আগে সিনেমাটির পরিকল্পনা করা। দর্শক যে রাজার বাড়ির সেট বা অন্যান্য সেটের প্রশংসা করছেন, এগুলো নিয়ে আমাদের দীর্ঘ গবেষণা করতে হয়েছে। আমরা আর্কিটেক্ট সাইফুল হক ভাইয়ের সহায়তা নিয়েছি। তিনি এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। সুসং দুর্গাপুরের ৭০–৮০ জন হাজং, গারো উপজাতির মানুষ তিন মাস ধরে কাজ করেছেন। তাঁরা জাতিগতভাবে এই অবয়বের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। এই মানুষেরাও আমাদের সহায়তা করেছেন। ঈদের পর আমরা তাঁদের জন্য আলাদা শো করব।
গান নিয়েও কথা হচ্ছে...
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: এটা তো মূলত মিউজিক্যাল ঘরানার ফিল্ম। এখানে ২৫টির মতো গান রয়েছে। এই গান দুই বছর ধরে সংগ্রহ করা। গানগুলোর সুরের ধারণা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন কফিল আহমেদ। দুই বছর মিউজিক নিয়ে ইমন চৌধুরী কাজ করেছেন। কিছু গান আমি নিজেও লিখেছি।
প্রধান চরিত্রে শরীফুল রাজকে কেন পছন্দ ছিল?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: ওর সঙ্গে এর আগে গুণিন সিনেমায় কাজ করেছি। তখন আমার কাছে মনে হয়েছিল, রাজ ভার্সেটাইল একজন অভিনেতা। ওকে দিয়ে চরিত্রটাকে গড়া যাবে। এ ছাড়া অভিনেতার মধ্যে যে রাজপুত্র লুক দরকার, সেটা তার মধ্যে পেয়েছি। ৪০০ বছর আগে সেই সময়ের রাজের লুক, অভিনয় কিন্তু দর্শকেরা পছন্দ করছেন। এটাই আমি চেয়েছিলাম। আমি সিক্স প্যাক কাউকে চাইনি।
কেন মনে হয়েছিল সিনেমাটি বানানো দরকার?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: এখন মানুষ আর লোকসংস্কৃতি পড়ে না। আমাদের অতীত সংস্কৃতি কতজন তরুণ জানে? কিন্তু নিজেদের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে কোনো জাতি এগোতে পারবে না। হয়তো আমাদের এই সিনেমার মাধ্যমে লোকসংস্কৃতি নিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে আগ্রহী হবে। তাদের মাধ্যমে আরও ১০০ বছর টিকে থাকবে এই সংস্কৃতি। কেউ রেফারেন্স চাইলে যেন সিনেমাটি দেখে সহায়তা পেতে পারে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম লোককথার মাধ্যমে জানুক আমাদের হাসি, কান্না, ক্রোধ, হিংসা, ষড়যন্ত্র, প্রেম কেমন ছিল। জাতির নিজস্বতা যেন হাজার বছর টিকে থাকে, সেটাই আমাকে সিনেমাটি নির্মাণে অনুপ্রাণিত করেছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে সিনেমাটি অনুদান পায়। শুটিং শুরু করতে কিছুটা দেরি করার কারণ কী?
গিয়াস উদ্দিন সেলিম: আমাদের সিনেমাটিকে ঠিকমতো তুলে ধরতে পরবর্তী সময়ে আরও অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। যে কারণে বাধ্য হয়েই প্রযোজক খুঁজতে সময় লেগেছে।