শিল্পকলায় অবদান রাখায় শিমূল ইউসুফকে একুশে পদকে ভূষিত করেছে সরকার। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেছেন তিনি। একুশে পদকসহ নানা বিষয়ে ‘বিনোদন’–এর সঙ্গে কথা বলেছেন এ অভিনয় ও সংগীতশিল্পী।
অভিনন্দন।
এটি আমার খুব কাঙ্ক্ষিত একটি পদক। ভেবেছিলাম, আরও আগেই হয়তো পাব। ষাট বছর ধরে কাজ করছি। সে হিসেবে ভেবেছিলাম, হয়তো অনেকের আগে পাব। বয়সে আমার ছোটদের মধ্যেও অনেকে পদকটি পেয়েছেন। আমার একটু দুঃখবোধও ছিল। আবার এটাও ভেবেছি, সবার জীবনে সময় নির্ধারণ করা থাকে। পদকটি আমার জীবনের বড় পাওয়া। সরকারের পক্ষ থেকে কাজের মূল্যায়ন করা হলে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু থাকে না। আমি খুবই আনন্দিত।
এর বাইরে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী?
আমার কন্যা এশা ইউসুফের জন্ম, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না। এশার জন্মের মধ্য দিয়ে আমি মাতৃত্ব পেয়েছি। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, তাঁকে বড় করতে পেরেছি।
প্রায় পাঁচ দশক ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে মঞ্চে কাজ করছেন।
আমার জীবন সংগীতময় ছিল, সংগীতকে ঘিরেই আমার বেড়ে ওঠা। শহীদ আলতাফ মাহমুদ নিখোঁজ হওয়ার পর আমার জীবনটা ঘুরে যায়। সংগীত ছেড়ে মঞ্চনাটকের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। রাইসুল ইসলাম আসাদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের মঞ্চে পেয়ে ভালো লেগেছিল। মঞ্চে নিয়মিত হওয়ার কারণে গাইতে না পারার দুঃখ ছিল, তবে তাঁদের স্নেহ–ভালোবাসায় দুঃখ ভুলেছিলাম। সংগীত ছেড়ে দিয়েছি, এমন নয়। মঞ্চ আমার জীবনের অনেকগুলো দরজা খুলে দিয়েছে। আমি যে গাইতে, সুরারোপ, চিত্রনাট্য সম্পাদনা ও কোরিওগ্রাফি করতে পারি, তা ঢাকা থিয়েটারের না এলে জানতামই না। সেলিম আল দীনের নাটক করেছি, তাঁর লেখা এমন জোরালো যে চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হয় না। লোভও সামলাতে পারিনি। নাটকই করলাম শেষ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের ফসল নাটক। নাটক সমৃদ্ধ করা আমাদের দায়িত্ব ছিল, তা–ই করেছি।
ভগ্নিপতি শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছে গান শিখেছেন। তাঁর সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কণ্ঠে তুলেছেন।
গানটি সরাসরি তাঁর কাছ থেকেই তুলেছিলাম, তখন আমি ছোট ছিলাম। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আমি তাঁর সঙ্গে প্রতিবছর শহীদ মিনারে যেতাম। গানটা এখন মোটামুটি ছেড়েই দিয়েছি। সব শেষ আবদুল গাফফার চৌধুরী লন্ডনে আমার কাছে শুনতে চেয়েছিলেন, তাঁকে শুনিয়েছিলাম। তারপর আর গানটি করা হয়নি।
যে স্বপ্ন নিয়ে মঞ্চে এসেছিলেন, তা কতটুকু পূরণ হয়েছে?
আমি নাটক থেকে সর্বোচ্চ আনন্দ পেয়েছি। আমি সন্তুষ্ট, আমার কোনো দুঃখবোধ নেই। আমি যে ধরনের চরিত্র করেছি, প্রতিটিই চ্যালেঞ্জিং ছিল। এখনকার কোনো অভিনেত্রীকে বনপাংশুল নাটকের ‘সুকি’ চরিত্রটি করতে বললে মনে হয় না কেউ সাহস করে করবেন। মনোযোগ ও নিজের সর্বোচ্চ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়েছি। নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় কাজটা করেছি।
গত দশক থেকে মঞ্চনাটকের অনেক শিল্পী টিভি নাটক ও সিনেমায় ঝুঁকছেন, পরে আর মঞ্চে ফেরেননি। এই প্রবণতাকে কীভাবে দেখছেন?
এটাকে আমি প্রবণতা বলব না, এটা জীবিকার তাগিদে করেন। আমরা মঞ্চ থেকে তাঁদের কিছুই দিতে পারি না। আমরা এখনো অপেশাদারই রয়ে গেছি। আমাদের মতো তো আর নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবেন না। মঞ্চে সময় দিয়ে মিডিয়াটা করলে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মিডিয়া করতে গেলে আর মঞ্চে সময় দেন না, এটাই দুঃখজনক।
স্বাধীনতার পর পাঁচ শতকেও ক্ষেত্রটি পেশাদার হয়ে উঠল না কেন?
সরকারি অনুদান একেবারেই কম; যেগুলো আছে, তা দিয়ে বছরে একটা নাটকও মঞ্চে তোলা যায় না।
তাহলে মঞ্চনাটকের ভবিষ্যৎ কী?
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে, শিল্পীদের সক্রিয় হতে হবে। যে যার আখের গুছিয়ে চলে যাবে, তা তো হয় না। আমরা দলের ছেলেমেয়েদের আসা–যাওয়ার ভাড়াটুকুও দিতে পারি না। নিজের খরচে আসে, নিজের খরচে যায়। মা–বাবা তাদের এভাবে কত দিন টানবেন? তাদের তো কিছু করতে হয়। এ জন্যই ছেলেমেয়েরা থাকে না।
দর্শক আপনাকে ‘মঞ্চকুসুম’ নামে ডাকে; কেমন লাগে?
আমার লজ্জা লাগে। কিন্তু কী করব, সুফিয়া কামালের সম্মতিক্রমে সেলিম আল দীনের দেওয়া। যাঁরা বলেন, তাঁদের খুব ভালো লাগে, কিন্তু আমার লজ্জা লাগে।
সামনে কী করছেন?
ঢাকা থিয়েটারের ৫০ বছর পূর্তি ২৯ জুলাই। তারপর আমরা কিছু পুরোনো নাটক নতুন করে মঞ্চে আনব। যৈবতী কন্যার মন, বনপাংশুল ও চাকা করার চেষ্টা করছি।