বলিউডের ‘পিপ্পা’ ছবিতে ব্যবহৃত নজরুলসংগীত ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। গানটির নতুন সুর ও সংগীতায়োজন করেছেন ভারতের অস্কারজয়ী সুরকার ও সংগীত পরিচালক এ আর রাহমান। ছবি মুক্তির আগে ইউটিউবে গানটি প্রকাশ করে তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। গানটি প্রসঙ্গে গতকাল রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন নজরুলসংগীত সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আনাম শাকিল
নতুন সংগীতায়োজনে তৈরি ‘কারার ঐ লৌহ–কবাট’ গানটি প্রথম আপনার নজরে এল কীভাবে?
শুক্রবার রাতে পরিচিত একজন আমাকে গানটির ভিডিও পাঠায়। এরপর বলল, দেখে বলেন কী করা উচিত। শুনে তো শুরুতে বুঝিইনি এটা কী গান, কোন গান! আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেছি। কাজী নজরুল ইসলামের কথা উঠলেই যে গানটা দিয়ে মানুষ উদাহরণও দেয়, সে রকম একটা প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় গানকে এভাবে বদলে ফেলল! বিষয়টা কী! শুনলাম, ভারতেও ব্যাপকভাবে এই গান নিয়ে নিন্দা হচ্ছে। এরপর গতকাল (শনিবার) নজরুল ইনস্টিটিউটে বাংলাদেশ নজরুলসংগীত সংস্থার ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করলাম, যাতে করে সব সংগঠন ও শিল্পীকে আকৃষ্ট করতে পারি। সবাইকে একসঙ্গে জড়ো করার চেষ্টা করলাম।
গানটি প্রথম শোনার পর অনুভূতি কী হয়েছে?
যখন দেখলাম এ আর রাহমান এই কাজ করেছেন, তখন সত্যিই অবাক হলাম। ভাবতে থাকলাম, এতটা দায়িত্বহীনভাবে এ কাজ তিনি কীভাবে করলেন! তবে কি এত বড় মাপের একজন সুরকার হয়ে তিনি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানেন না! স্বদেশি আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিসংগ্রাম পর্যন্ত সব সময় যেকোনো আন্দোলনে এই গান প্রথম দিকে গাওয়া হয়েছে। এত প্রতিষ্ঠিত সুরের একটি গান, যেটি বাণী ও সুরের কারণে এই ধরনের একটি মাত্রা পেয়েছে, সে ধরনের একটি গানকে তিনি একেবারে নতুনভাবে এ রকম সুর করলেন! প্রথম যে অনুভূতি হয়েছে, তিনি যদি কাজী নজরুল ইসলামের সুর জেনে থাকেন, তাহলে তিনি সম্পূর্ণভাবে অসম্মান করেছেন। এটা কাজী নজরুল ইসলাম না হয়ে সাধারণ কোনো সুরকারের কাজ হতো, তা–ও বলব, সেই সুরকারের অনুমতি নিয়ে কাজটা করতে পারতেন—সেটাই ভদ্র উপায়। যে ব্যক্তি তাঁকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন, যে শিল্পীরা গেয়েছেন, মনে করি, প্রত্যেকে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি অসম্মান দেখিয়েছেন।
গানটির এ রকম উপস্থাপনের প্রধান দায় কাদের বলে মনে করছেন?
ছবিতে যাঁরা গানটি এভাবে উপস্থাপনের কথা ভেবেছেন, সেই ছবির প্রযোজক, পরিচালক এবং তাঁকে যারা পরামর্শ দিয়েছেন—তাঁদের বড় দোষ। এরপরে আসে এ আর রাহমানের কথা। এখন এ আর রাহমান যদি শুধু বাণীটা পেয়ে গানটা এভাবে বানান, তাহলে নিশ্চয় তিনি অরিজিনাল গানটা শুনেছেন। এই গানের জোরালো ব্যাপারটার কথা তিনি জানেন। তিনি হয়তো চেষ্টা করেছেন একটু ভিন্নভাবে। যদিও আমি ছবিটা দেখিনি, কোন দৃশ্যে গানটা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানেও দেখার বিষয় আছে। যদি হালকা পরিস্থিতিতে গানটা উপস্থাপনা করা হয়, সেটা আরও বড় ধরনের একটা অসম্মান।
ভুল না অপরাধ—আপনার বিবেচনায় এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অনেকে এ–ও বলছেন, এ আর রাহমান জেনে করেছেন। এমনও হতে পারে, তিনি জেনে করেননি। বিষয়টা আবার এমন না, তিনি এ আর রাহমানকে সাপোর্ট করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি এমন একটি গান না জেনেই–বা কেন করবেন! এমন যদি হয়, কাজী নজরুল ইসলামের নামই শোনেননি, সেটা তো ভিন্ন কথা। আবার এটাও ঠিক না শোনারও কথা না। তিনি কিন্তু ‘জনগণমন’ গানটি করেছেন, যিনি রবীন্দ্রনাথের কথা জানেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের নামও জানেন। আমরা যখনই পাঁচ কবির কথা বলি, তখন পাশাপাশি যে দুজন কবির কথা বলি তাঁরা হচ্ছেন রবীন্দ্র–নজরুল। রবীন্দ্রনাথের পর একমাত্র নজরুলই এমন একটা ইম্প্রেশন তৈরি করতে পেরেছেন। একটা ভিন্ন আঙ্গিকের গান, ভিন্ন ছন্দের কবিতা, ভিন্ন ছন্দের লেখা, ভিন্ন ধরনের সুর এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের ভিন্ন ধারা নিয়ে কাজ করে গান, কবিতা ও নানা কিছুতে নতুনত্ব এনেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সে জন্য নজরুলের নামটা ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। আমি নিশ্চিত, যাঁরা ছবিটা তৈরি করেছেন, সেই প্রযোজক, পরিচালকের মধ্যে বাঙালি কেউ ছিলেন, তাঁরা তো নিশ্চয় গানটা আগে শুনেছেন, নাহলে পছন্দ করলেন কীভাবে! তাই এটা বড় ধরনের অন্যায়। সঙ্গে সঙ্গে এ আর রাহমানের খোঁজখবর নিয়ে কাজটাতে হাত দেওয়া উচিত ছিল।