সম্প্রতি লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে ভারতের চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ‘পারদো আল্লা ক্যারিয়েরা’পেয়েছেন শাহরুখ খান। এরপর উৎসবের আর্টিস্টিক পরিচালক জোনা এ নাজারোর সঙ্গে আলাপচারিতায় অংশ নেন ভারতীয় অভিনেতা। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন মনজুরুল আলম
৭৭তম লোকার্নো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আপনাকে স্বাগত। আপনি শুধু এ মিলনায়তনেই নেই, অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছে...
শাহরুখ খান: যাঁরা আমাকে চেনেন না তাঁরা দয়া করে চলে যাবেন না প্লিজ। গুগল করুন এবং ফিরে আসুন (হাসি)।
আপনি সিনেমার প্রেমে পড়লেন কখন, কীভাবে?
শাহরুখ খান: তার আগে নিজের সম্পর্কে বলে নিই, পৃথিবীর দর্শক আমাকে শাহরুখ খান নামেই চেনে। আমার বয়স ৫৮ বছর। আমি ভারতে হিন্দিতে ৬৮টি সিনেমা করেছি। ৩২–৩৩ বছর ধরে সিনেমার সঙ্গে রয়েছি। টেলিভিশনেও কিছু কাজ করেছি। অতিথি চরিত্রে কিছু সিনেমায় কাজ করেছি। ভারতে অতিথি চরিত্র মানেই ফ্রিতে কাজ করা (হাসি)। তখন আমি অনেক তরুণ। আমার সিনেমায় অভিনয়ের ইচ্ছাই ছিল না। কিন্তু আমি স্কুলে ১০০ মিটার দৌড়, অভিনয়ে নাম লেখাতাম, ছবি আঁকতাম, বিজ্ঞানের প্রদর্শনীগুলোয় নাম লেখাতাম। তখন সিনেমা ছিল বিনোদনের অনেক বড় মাধ্যম।
মা ছিলেন সিনেমার ভক্ত। আমরা ভারতের সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি। আমরা বিশ্বাস করি, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। যে কারণে মা সব সময় বলতেন, ‘পা টিপে দে।’ রাতে যখন পা টিপে দিতাম, তখন প্রায়ই মাকে দেখতাম সিনেমা দেখতে। একটা–দুটো সিনেমা দেখতে দেখতে আমিও সিনেমা দেখতে পছন্দ করা শুরু করি।
আমি যে স্কুলে পড়েছি সেখানে ইংরেজির ওপর খুবই গুরুত্ব দেওয়া হতো। একসময় হিন্দিতে দুর্বল হয়ে পড়ি। তখন মা আমাকে বলেন, ‘তোকে নিয়ে সিনেমা হলে যাব, দেখবি হিন্দিতে ১০–এ ১০ পাবি।’ এটা আমি কখনোই বলিনি, আমার বন্ধুর খাতা দেখে একটি মন্তব্য লিখে ১০–এ ১০ পেয়েছিলাম। মা আমাকে নিয়ে নিয়মিত সিনেমা দেখাতে শুরু করলেন। অদ্ভুতভাবে ও ঘটনাক্রমে জোশিলা নামে একটি সিনেমা চোখে পড়ে। সেই সিনেমার পরিচালকের সঙ্গে আমি বেশির ভাগ সিনেমা করেছি পরে। তিনি যশ চোপড়া। আজ আমি যে লোকার্নোতে বসে কথা বলছি, এটাও তাঁর জন্য।
পরে আমার বাবা মারা যান। আমি নিজের শহর ছেড়ে চলে আসি। গণযোগাযোগ নিয়ে পড়াশোনা করি। সেই সময়ে আমি চলচ্চিত্র নির্মাতা হতে চেয়েছিলাম। মুম্বাইয়ে চলে আসি। কিছু চরিত্রে কাজ করার সুযোগ পাই। তখন ভাবি, ক্যামেরার সামনে কাজ করব।
১৯৯০ সালে মুম্বাইয়ে আসি। তখন বলেছিলাম বছরে এক লাখ রুপি আয় করব। নিজের জন্য একটা বাড়ি করব। আবার ফিরে যাব বিজ্ঞানী হওয়ার জন্য অথবা সাংবাদিক হব। কিন্তু আর ফিরে যেতে পারিনি।
মা ছিলেন সিনেমার ভক্ত। আমরা ভারতের সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি। আমরা বিশ্বাস করি, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। যে কারণে মা সব সময় বলতেন, ‘পা টিপে দে।’ রাতে যখন পা টিপে দিতাম, তখন প্রায়ই মাকে দেখতাম সিনেমা দেখতে। একটা–দুটো সিনেমা দেখতে দেখতে আমিও সিনেমা দেখতে পছন্দ করা শুরু করি।শাহরুখ
আপনি তো সব সময়ই নায়ক ছিলেন না, খল চরিত্রেও নাম লিখিয়েছেন; সেখানে থেকে কী ভেবে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনলেন?
শাহরুখ খান: আমি যখন মুম্বাই আসি তখন আমার বয়স ২৫ কি ২৬ বছর। তখন বেশির ভাগ সিনেমাই ছিল কলেজের প্রেম নিয়ে। অদ্ভুতভাবে তখন চেয়ার–টেবিলের সামনে বসে থাকতে হতো। আচরণ করতে হতো আমি কলেজে পড়ি। এটা আমার কাছে খুবই বেমানান লাগত। কিন্তু ৩২ বছর বয়সে যখন কুছ কুছ হোতা হ্যায় সিনেমায় একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করি, তখন বেমানান মনে হয়নি (হাসি)। পরে আমি একজন বিখ্যাত পরিচালকের সঙ্গে দেখা করি। তাঁর নাম আমি বলব না। তিনি বললেন, ‘দেখতে তুমি খুবই আগলি। দেখছ, অন্য নায়কেরা দেখতে কেমন সুইস চকলেটের মতো হয়!’ বললাম, দেখতে যেহেতু খারাপ তাহলে আমি সেই রকম চরিত্রেই অভিনয় করব। সেভাবেই খল চরিত্রে অভিনয় করা। পরে যশ চোপড়া একদিন ডেকে বললেন, ‘তোমাকে লাভ স্টোরিতে নিতে চাই। তুমি দেখতে অতটা খারাপ নও।’ তিনি দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে বানালেন। সেই থেকে আমি ‘সুদর্শন’ হয়ে গেলাম।
আপনার সিনেমায় যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া কী?
শাহরুখ খান: এটা খুবই সহজ। প্রথমেই বলে নিই, আমি খুব বেশি সিনেমা করি না। অনেক সময় নিয়ে কাজ করি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই অভিযোগ করেন, আরও সিনেমা কেন করছি না। একটা সিনেমায় অনেক সময় নিই কারণ, যিনি আমাকে পরিচালনা করবেন তাঁর সঙ্গে সময় কাটাই। অনেক মজা করি, একসঙ্গে খাই, একে অন্যকে জানার চেষ্টা করি। সিনেমা নিয়ে কথা বলি। এ প্রক্রিয়াগুলো আমি উপভোগ করি। কেউ আমাকে সিনেমার গল্প শোনালে সেগুলো শুনি। হয়তো এসে বলবে, ‘স্যার একটা সাবজেক্ট আছে।’ আমি আমার চিন্তার সঙ্গে, গল্পটা কোন ঘরানার সেটা মেলানোর চেষ্টা করি। আবার অল্প একটু গল্প শুনেও কোনো সিনেমা পছন্দ করি ফেলি। আবার দুই–তিন ঘণ্টা ধরে গল্প শুনেও হতাশ হয়ে যাই।
কটা সিনেমায় অনেক সময় নিই কারণ, যিনি আমাকে পরিচালনা করবেন তাঁর সঙ্গে সময় কাটাই। অনেক মজা করি, একসঙ্গে খাই, একে অন্যকে জানার চেষ্টা করি। সিনেমা নিয়ে কথা বলি।শাহরুখ
আপনি তো নারী নির্মাতাদের পরিচালনায় অভিনয় করেছেন। নারী ও পুরুষ নির্মাতার সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে কী ধরনের পার্থক্য চোখে পড়েছে?
শাহরুখ খান: আমার কাছে প্রায় একই মনে হয়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে পার্থক্য পেয়েছি। সেটা বড় কোনো পার্থক্য নয়। আমি সহকর্মী, প্রযোজক, পরিচালক হিসেবে নারীদের পেয়েছি। পুরুষদের চেয়ে তাঁরা অনেক গোছানো। সংবেদনশীলতার জন্য নারীদের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি। সত্যি বলতে, আমি পুরুষ নির্মাতাদের ছোট করতে চাই না। সঞ্জয়লীলা বানসালি, করণ জোহর, মণিরত্নমদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা দারুণ। কিন্তু একটি সিনেমাকে তার রং, বিন্যাসে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নারীরাই তুলে ধরতে পারেন। তাঁদের সবকিছুতেই আলাদা ছাপ থাকে। তাঁরা শুটিংয়ে অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল থাকেন। ফারাহর (খান) কথাই বলি, তিনি শুটিংয়ে আমাদের ভালো খাওয়ান, তাঁর সেন্স অব হিউমার অন্য রকম। তাঁর সঙ্গে ওম শান্তি ওম, ম্যায় হু নাসহ সব শুটিংয়ে অনেক মজা করেছি।
আপনার সিনেমার বড় একটা অংশে থাকে মারপিট ও নাচ, এসবের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা থাকে কতটা?
শাহরুখ খান: অ্যাকশন দৃশ্যগুলো অনেক কঠিন। এর জন্য অনুশীলন করতে হয়। যদিও স্টান্টম্যান থাকেন। কিন্তু চূড়ান্তভাবে ৮০ শতাংশ দৃশ্যে নিজেই সম্পৃক্ত থাকি। পরবর্তী সিনেমার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ওজন কমিয়েছি। সব মিলিয়ে এই যাত্রাটা সহজ নয়, কষ্টকর। আট-নয় বছর আমি থিয়েটার করেছি। সে সময় থেকেই গান করেছি, নেচেছি। তবে সব কোরিওগ্রাফিতে আমার নিজের অবদান থাকে। গানের কথা বুঝে প্রস্তুতি নিতে হয়। বোঝাপড়ার মাধ্যমেই নাচের স্টেপগুলো ঠিক করি।
একটি সিনেমাকে তার রং, বিন্যাসে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নারীরাই তুলে ধরতে পারেন। তাঁদের সবকিছুতেই আলাদা ছাপ থাকে। তাঁরা শুটিংয়ে অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল থাকেন। ফারাহর (খান) কথাই বলি, তিনি শুটিংয়ে আমাদের ভালো খাওয়ান, তাঁর সেন্স অব হিউমার অন্য রকম।শাহরুখ
আপনার ‘দেবদাস’ সিনেমা নিয়ে বেশ কিছু গল্পও রয়েছে, এটা কি ভাগাভাগি করতে চান?
শাহরুখ খান: এটা বিশেষ একটি সিনেমা। সিনেমাটি আমার মায়ের পছন্দের ছিল। বাবাও সিনেমাটি নিয়ে কথা বলতেন। আগে দিলীপ কুমার, বাংলার উত্তম কুমার সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন। বিভিন্ন সময় রিমেক হয়েছে। শৈশবে বাবা–মায়ের সঙ্গে দেবদাস দেখেছি। তখন মনে হতো দেবদাস নামের একজন মাদকাসক্ত, কিশোর বয়সে এই গল্পের কোনো তাৎপর্য পাইনি। অনেক বছর পরে যখন সঞ্জয়লীলা বানসালি বললেন, ‘আমি দেবদাস করতে চাই।’ বললাম, ‘দেবদাস’ লুজার, মদ খায়। এই চরিত্র করব না। আমি শান্তশিষ্ট ‘দেবদাস’ হতে চাই। তিনি বললেন, ‘তুমি না করলে এই সিনেমা আমি করব না। কারণ, তোমার চোখ “দেবদাস”-এর মতো।’
এক বছর আর কথা হলো না। পরে আবার দেখা হলো। তখন জানালাম, আমার মতো চোখের কাউকে যদি খুঁজে না পান তাহলে আমি সিনেমাটি করব। পরে এ সিনেমাটি আমাকে জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা দিয়েছে। কেউ কিন্তু কখনোই তার সন্তানকে বলবে না, ‘তুমি “দেবদাস”-এর মতো হও।’ বলা যায় নেতিবাচক চরিত্র। কিন্তু সেই চরিত্র যখন দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয়তা পায় তখন বলতে হয়, এটা আমার অর্জন। ভালো লাগছে সিনেমাটি লোকার্নোতে দেখানো হচ্ছে। আমি চরিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য মদ খেতাম, এমনিতে আমি মদ খাই না। কোনো রাতে মাধুরী দীক্ষিত, কোনো রাতে ঐশ্বরিয়া রাইয়ের নাচের দৃশ্য থাকত। একপাশে জ্যাকি শ্রফ। আমি শুধু মদ খেতাম। দিন শেষে দেখা যেত, তারা সবাই বলত, ‘অনেক কঠিন কাজ করেছ, গড ব্লেস ইউ (হাসি)।’ অর্ধেক সিনেমাই ছিল এমন। এগুলো দারুণ অভিজ্ঞতা।
“সঞ্জয়লীলা বানসালি বললেন, ‘আমি দেবদাস করতে চাই।’ বললাম, ‘দেবদাস’ লুজার, মদ খায়। এই চরিত্র করব না। আমি শান্তশিষ্ট ‘দেবদাস’ হতে চাই। তিনি বললেন, ‘তুমি না করলে এই সিনেমা আমি করব না। কারণ, তোমার চোখ “দেবদাস”-এর মতো।’ এক বছর আর কথা হলো না।’’শাহরুখ
সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে আপনার আত্মিক সম্পর্কের শুরুটা কীভাবে হলো?
শাহরুখ খান: আমি দিল্লির নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি। আশির দশকের সেই সময়ে সুইজারল্যান্ডে আসা ছিল স্বপ্নের মতো। তখন কাশ্মীরকে বলা হতো ভারতের সুইজারল্যান্ড। পরবর্তী সময়ে আমি অনেক সিনেমার শুটিং করেছি সুইজারল্যান্ডে। সবুজ, বরফ জীবনেও যা দেখেনি সেগুলো দেখে ভালো লাগার শুরু। সুইজারল্যান্ড আমার ক্যারিয়ার বদলে দিয়েছে। আমার রোমান্টিক বেশির ভাগ সিনেমার শুটিং এখানে হয়েছে। আমি এখন সুইস চকলেট বয়। আমি যখন এখানে আসার কথা টিমকে বলি, তারাও আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছে। উৎসবে সর্বোচ্চ পুরস্কারের জন্য কৃতজ্ঞতা। এখন আপনারা আমাকে সুইজারল্যান্ডের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেন (হাসি)। অথবা রজার ফেদেরারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। কিছু একটা করেন (হাসি)।