আজ বৃহস্পতিবার তার বাড়ি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় ফেরা হচ্ছে না। অভিনেতা ও উপস্থাপক আবু হেনা রনি এখনো শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। বর্তমান শারীরিক অবস্থা, কাজে ফেরা নিয়ে হাসপাতালের বিছানা থেকে কথা বললেন তিনি
এখন কেমন আছেন?
এখন ৮৫ ভাগ ভালো বলা যেতে পারে। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন দু–এক দিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারব, সেটা আর হচ্ছে না। নিয়মিত ড্রেসিং হচ্ছে। চিকিৎসকেরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সামান্য কিছু জটিলতা থাকায় আগামী শনি বা রোববারে হয়তো হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরতে পারব।
বাড়ি ফিরেও তো চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে?
হ্যাঁ। আমার শরীর এখন খুবই সেনসেটিভ। বাড়িতে ফিরেও শরীরে গরম, ধুলাবালি একদম লাগানো যাবে না। ২৪ ঘণ্টা সতর্ক থাকতে হবে। বাড়িতে পুরো পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে।
আপনার ফুসফুস আগুনে আক্রান্ত হয়েছিল, এই জটিলতা কতটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন?
ফুসফুসের অবস্থা খুবই গুরুতর ছিল। সবার আগে সেটির চিকিৎসা হয়েছে। গলায় কিছুটা সমস্যা ছিল, এখন ঠিক হয়েছে। এখন পুরো বিশ্রামে থাকতে হবে।
প্রথম তো আক্রান্ত হয়েছিল মুখ?
হ্যাঁ। মুখে প্রথম আগুন লেগেছিল। এখন আমার মুখে পুরোটাই নতুন চামড়া গজিয়েছে। মুখ আস্তে আস্তে আগের মতো হয়ে যাবে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে আগে কিছু ওষুধ খেতে পারিনি। এখন নতুন ওষুধ খেতে হচ্ছে। আফটার ইফেক্টের সমস্যা নেই।
১৬ সেপ্টেম্বর, সেদিন আসলে কীভাবে ঘটনাটা ঘটেছিল?
প্রায় ১০০ গ্যাস বেলুন ছিল। ওই বেলুনগুলো উড়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু ওড়েনি। পরে শুনেছিলাম, বেলুনে লোকাল গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। এমনকি লোকালভাবে এগুলো বানানো হয়েছিল। যারা বেলুনগুলো বানিয়েছিল, তারা বলল, গ্যাস বেলুনগুলো যে উড়ছে না তার কারণ এর সঙ্গে থাকা শুভ উদ্বোধন লেখা কাপড়টা ভারী। ওটা কেটে ফেলতে হবে। কাটার জন্য আশপাশে কিছুই ছিল না। পরে ম্যাচলাইটের আগুন দিয়ে কেটে ফেলতে গিয়ে গ্যাস বেলুনগুলো আগুনের উৎস পায়। মুহূর্তের মধ্যে সব বেলুনে বিস্ফোরণ ঘটে। মনে হলো হাইড্রোজেন বোমা ফেটেছে। কিছুই বুঝতে পারিনি, আসলে কী হয়ে গেল। মনে হয়েছিল, এই বুঝি মারা যাচ্ছি, জীবন শেষ।
তার পরের সময়গুলোর কথা মনে আছে?
ওই সময়ে প্রাথমিক চিকিৎসাটা আমার জরুরি ছিল। পরে তো সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। দুই দিন আইসিইউতে থাকতে হয়েছিল। সেই সময়ে প্রায় ১২–১৩ দিন নিজের মুখটা ঠিকমতো দেখিনি। পুরো শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। ওই সময় নিজের চেহারা নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় ছিলাম না। মেয়ে হলে হয়তো চেহারা নিয়ে ভাবতাম। বার্নের ব্যথা অন্যরকম। এই ব্যথা মেনে নেওয়ার মতো না। চাইছিলাম, যেকোনো মূল্যে ব্যথা আগে কমুক।
দেশ–বিদেশের অনেক সহকর্মী আপনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন...
কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরে দেখলাম, যেভাবে সহকর্মী ও পরিবারসহ সবাই আমাকে ভালোবাসছে, এটা আমার কাছে অবিস্মরণীয়। চিকিৎসক ও নার্স সেবা করতে এসে বলছেন, তাঁদের পরিবারের লোকজনও আমার জন্য দোয়া করছেন। চিকিৎসকদের অন্যরকম আন্তরিকতা, পুলিশের পক্ষ থেকে সব সময় খবর নেওয়া। এর মধ্যে দেশ–বিদেশ থেকে সবাই আমার পাশে দাঁড়ালেন, কেউ কেউ দেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকায় চিকিৎসার ব্যবস্থার কথা বললেন। এত মানুষের দোয়া ভালোবাসা আমার জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। আগুনে না পুড়লে হয়তো এই ভালোবাসা বুঝতে পারতাম না।
কাজে ফেরা কতটা টানছে?
একজন শিল্পী কাজে ফেরার জন্য সব সময় মুখিয়ে থাকেন। দেখবেন, অনেক শিল্পী বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, মুমূর্ষু; কিন্তু মরার আগ পর্যন্ত কাজ করে যেতে চান। এটা অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে নয়, এটা কাজকে ভালোবাসা। দীর্ঘ এক মাস কাজের বাইরে থেকে এখনো প্রতিটা মুহূর্ত মনে হয়, আবার কবে কাজে ফিরব, কবে দর্শকদের কাছে যাব, কবে দর্শকদের সঙ্গে হাত মেলাব। শিল্পী হিসেবে এটা আমার অন্যরকম উপলব্ধি। তবে সবার উদ্দেশে একটি সচেতনতার কথা বলব।
কী ধরনের সচেতনতার কথা?
শুধু আগুনে পোড়া নয়, যেকোনো অ্যাক্সিডেন্টের প্রাথমিক চিকিৎসা কী হবে সেটা আমরা আগে থেকে কেউ খোঁজ রাখি না। এটা নিজের জন্য না হলেও অন্যের জন্য জেনে রাখা দরকার। আমি যখন আগুনে পুড়ে পড়ে যাই, সেন্সলেস অবস্থা, তখন আশপাশে অনেক মানুষ; কিন্তু তাঁরা কেউ জানেন না এই পোড়ার প্রাথমিক চিকিৎসা কী? যদি জানা থাকত বার্নের রোগীকে প্রচুর পানি ঢালতে হয়, আমার মুখে শরীরে যদি পানি ঢালা হতো, তাহলে এতটা ক্ষতি হয়তো হতো না। সবার সচেতন থাকা দরকার।
এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে জীবন নিয়ে নতুন কোনো উপলব্ধি হয়েছে?
জীবনটা একবারের জন্যই পেয়েছি। জীবনটাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা উচিত। জীবনের প্রতিটা দিন আনন্দে থাকা দরকার। একসময় টাকা হলে এই করব সেই করব, ভবিষ্যৎ ভবিষ্যৎ করেই আমরা হা–হুতাশ করি। ভবিষ্যতের চাপে আমাদের বর্তমানটাই হারিয়ে যায়। অথচ বর্তমান দিনগুলোতে ভালো থাকা দরকার। শুভাকাঙ্ক্ষী তৈরি করা দরকার। দিন শেষে মানুষ হিসেবে অন্যদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা দরকার। আমাকে সবার এতটা ভালোবাসার কারণ, আমি জীবনে কারও ক্ষতি করিনি। পারলে উপকার করেছি।
গত এক মাসে ব্যস্ততা কী ছিল?
বাংলাভিশনে উপস্থাপক হিসেবে ‘টক মিষ্টি ঝাল’ নামে রেগুলার একটা অনুষ্ঠান করি, সেটার শুটিং ঝুলে আছে। সেপ্টেম্বর জুড়েই দেশে অনেক প্রোগ্রাম ছিল, সবই বাতিল করতে হয়েছে। এ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ঢালিউড অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেওয়ার কথা ছিল, যেতে পারব না। সিঙ্গাপুরে একটি অনুষ্ঠান ছিল যেতে পারব না। তবে আমার হাতটা ঠিক হলেই শিগগির কাজে ফিরব।