‘সত্তা’র পর আবার শুটিংয়ে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতীয় অভিনেত্রী পাওলি দাম। সপ্তাহখানেকের বেশি সময় ধরে তিনি ছবির শুটিং করছেন। ‘নীল জোছনা’ নামের ছবিটি বানাচ্ছেন ফাখরুল আরেফীন খান। শুটিংয়ের অবসরে গত বুধবার ছবিটিসহ অন্যান্য প্রসঙ্গে জানতে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিলেন মনজুর কাদের।
২০১৭ সালেও যখন ‘সত্তা’ শুটিং করছিলেন, তখন কলকাতার খুব বেশি শিল্পী ঢাকাই সিনেমায় কাজ করতেন না। কিন্তু এরপর দুই বাংলার শিল্পীরা ঢাকা-কলকাতায় অনেকটাই নিয়মিত হলেও আপনাকে আর বাংলাদেশের সিনেমায় দেখা যায়নি।
পাওলি দাম : কোভিডের আগে দুই বাংলার একটা অ্যাওয়ার্ড ফাংশন হয়েছিল। ভারত-বাংলাদেশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডের সেই আয়োজনে শেষবার বাংলাদেশে আসা। তারপর কিছু ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে আমার কথা হয়। কোভিডের কারণে হয়ে ওঠেনি। এদিকে কোভিডের পর থেকে আমার হিন্দি কাজের সংখ্যাটা বাড়তে থাকে। ওই সময় ওটিটিতে হিন্দি কাজ বেশি করেছি। তখন ওটিটির একটা বড় প্রভাবও শুরু হলো। কারণ, আমরা তো থিয়েটারে যেতে পারছিলাম না। সবাই ওটিটির কাজ দেখছিলেনও। আমিও করলাম বুলবুল, রাত বাকি হ্যায়, দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মার্ডার, কর্ম যুদ্ধ, বিশাল ভরদ্বাজের চার্লি চোপড়া দ্য মিস্ট্রি অব সোলাং ভ্যালি। তবে ফিচার ফিল্ম করা হয়নি। বলিউডে অবশ্য তখন ফিচার ফিল্ম হচ্ছিলও কম।
‘নীল জোছনা’ করতে রাজি হলেন কেন? এ সিনেমার কোন দিকটি আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করছে।
পাওলি দাম : সবচেয়ে ভালো লাগার কারণ, জনরা। সত্যি বলতে, এই ছবিতে অভিনয়ে রাজি হওয়ার একটাই কারণ, প্যারা সাইকোলজি—প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে একটা গল্প হচ্ছে, যেমনটা বাংলায় খুব কম হয় হয়েছে। তবে বিশ্বজুড়ে অনেক দেখতে পারব। ইন্টারস্টেলার যেমন আছে, তেমনি এভরিথিং এভরিহোয়ার অল অ্যাট ওয়ানসও আছে, যেটা অস্কারও পেল। নীল জোছনা হচ্ছে প্যারালাল ইউনিভার্স প্যারা সাইকোলজি নিয়ে। অদ্ভুত শোনাবে, কোভিডের পর এ ধরনের বিষয় নিয়ে অনেক কাজ দেখছিলাম। পড়ছিলামও। এ সময়ই আরেফীন আমাকে ছবিটার কথা বললেন, কাকতালীয় ব্যাপার। এভাবেই হয়তো কাজ হয়, যেটা হওয়ার। গত বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, এখন শুটিং করছি।
দীর্ঘ বিরতির পর ঢাকায় সিনেমায় কাজ করলেন। কেমন অভিজ্ঞতা।
পাওলি দাম : বিষয়টা একদম অন্য রকম। এই ছবিতে গ্রিন স্ক্রিনের বিপরীতে অনেক শুটিং হচ্ছে, যেটা আমাদের ছবির ক্ষেত্রে নিয়মিত নয়। প্রযুক্তিগত পুরো ব্যাপারটি একেবারে নতুন। জনরাও নতুন। ভালো লাগছে এই ভেবে, ছবিতে বাংলাদেশের খুব নামকরা কয়েকজন শিল্পী আছেন। আমি আর ডিওপি ভারত থেকে আসছি। পার্থ বড়ুয়া তো খুব মজার মানুষ। শুটিং সেটে বিরক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, আনন্দ নিয়ে কাজটা করছি। পার্থদার গান শুনেছি, সোলসেরও—এবার অভিনয় করছি। নাঈম আমার স্বামীর চরিত্র করছেন। মেহের আফরোজ শাওন আপাও দারুণ একটা চরিত্র করছেন। আফসানা মিমি আপা আছেন ক্রিয়েটিভ বিভাগে, উনার সঙ্গেও আলাপ হলো। এই যে দুই বাংলার চলাচল শুরু হলো, যেটা আমি বহুদিন আগেও তোমায় বলেছিলাম, মনের মানুষ ও সত্তা করতে এসেও। আমার মনে হয়, আরও একজোট হতে পারলে, যেমন সত্তায় শাকিব আর আমি একসঙ্গে কাজ করলাম, এরপর যদি আরও কাজ করতাম, তাহলে বাধার দেয়াল আরও তাড়াতাড়ি ভাঙত। সুযোগের যেমন ব্যাপার আছে, উদ্যোগেরও ব্যাপার আছে—দুই বাংলার উদ্যোগের খুব প্রয়োজন।
কেন এমনটা মনে হচ্ছে?
পাওলি দাম : পৃথিবীব্যাপী বাঙালি দর্শক প্রচুর। প্রত্যেকে যদি নিয়মিত বাংলা ছবি দেখেন—অন্য ভাষার কাজও দেখুক, কিন্তু প্রাধান্য থাকুক বাংলা ছবি—তাহলে আমাদের কনটেন্ট বিশাল বিক্রি হবে। দুই বাংলার শিল্পীরা যখন একসঙ্গে এগোবেন, তখন প্রভাবটাও তো অনেক বেশি হবে, তাই না। যেটা হয়ে আসছে। মাঝখানেও হয়েছিল। বছরে একটি-দুটিতে হবে না। এই সংখ্যা বাড়াতে হবে। আরও নিয়মিত হতে হবে। আমি চার বছর পর এসেছি। আমার কাছে কনসেপ্ট, কনটেন্ট ও চরিত্রটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি আরও ইন্টারেস্টিং কনটেন্ট পাই, যেটা আমাকে ক্রিয়েটিভলি টানবে, ভালো কাস্ট অ্যান্ড ক্রু যদি থাকে, তাহলে আরও বেশি করা হবে। আরও বেশি আসা হবে। এটা যদি আমরা আরও বাড়াতে পারি, তাহলে যে লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছি—বাংলা কনটেন্ট বিশ্বের আরও বড় জায়গায় যাবে।
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সিনেমা ও সিরিজে একটা বদল এসেছে। ঢাকার অনেক কাজ কলকাতায় ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের ঢাকার কাজগুলো কী দেখা হয়েছে?
পাওলি দাম : সিনেমা, সিরিজ—সবই ভালো যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রিয়তমা, হাওয়া, এখন তুফান চলছে। চরকিও দারুণ সব কাজ করছে। আমি হাওয়া সিনেমাটি ওটিটিতে দেখে চঞ্চলের সঙ্গে কথাও বলেছি। কলকাতায় গেলেও আমাদের কথা হয়। কনটেন্ট ওয়াইজ এখন অনেক সমৃদ্ধ কাজ হচ্ছে, যেটা চার-পাঁচ বছর আগেও হচ্ছিল। ওটিটিতে গল্পের আলাদা চাহিদা আছে, যেটার ট্র্যাডিশনাল সিনেমার সঙ্গে কোনো কনফ্লিক্ট বা ক্ল্যাশ নেই—এটা আমি বরাবরই বলে আসছি। যত বেশি সংখ্যক প্ল্যাটফর্ম আসবে, তত বেশি বৈচিত্র্যময় কাজ তৈরি হবে। কলাকুশলীরাও কাজের সুযোগ পাবেন। আমার যদি একটা প্ল্যাটফর্ম থাকে, সেটার নম্বর অব ওয়ার্ক যেটা, সেটা তো কমই হবে। এক অর্থে সেটা ভালোও। নারীকেন্দ্রিক গল্পের কথা বলব, যেটা আমি বড় পর্দায় অনেক সুযোগ পেয়েছি, যা সবার হয়তো হয়নি। ওটিটির জন্য আরও বেশি দেখতে পারবেন।
আপনি ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন। ‘কালবেলা’, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এর মতো সিনেমা করেছেন। সেই সময় আপনাকে পরের দশকের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন মনে করা হয়েছিল। আপনার কী মনে হয়, সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পেরেছেন?
পাওলি দাম : দর্শকেরা প্রত্যাশা তখনই করবেন, যখন সম্ভাবনা দেখবেন। আমার দায়িত্ব হচ্ছে দর্শকদের আরও ভালো ভালো কাজ উপহার দেওয়া। যে কারণে বৈচিত্র্যময় কাজ, জনরা, কনটেন্ট—এগুলো সব সময় খুঁজি। আমার এটুকুই বিশ্বাস আছে, যে কনটেন্টগুলো আমি খুঁজি, সেটা মানুষ পরবর্তী সময়ে পছন্দ করেন, ভালোবাসেন। যে পরিচালকেদের নাম তুমি বললে, তাঁদের বিকল্পও তো তৈরি হতে হবে, তবেই তো...। সেটা কি তৈরি হচ্ছে? আমি নিজের থেকে পেডেস্টাল রাখি না, রাখবও না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো শিল্পীকে অ্যাডাপ্ট করতে হয়। আমিও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে নতুন কাজকর্ম, নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করতে ভালোবাসি। যাঁরা কিংবদন্তি, তাঁরা তো আছেনই। গৌতমদার (ঘোষ) সঙ্গে সব সময় কাজ করতে ভালো লাগে। তাঁর মতো পরিচালক পাওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। যখনই আমাদের দেখা হয়—চলো, লেটস ডু সামথিং এগেইন। প্রত্যেক পরিচালক গৌতমদার মতো হবেন, সেটাও ঠিক নয়। প্রত্যেকের আলাদা বিশেষত্ব বা দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকে। আমার সব সময় মনে হয়, আমি যে কাজটা করিনি, যে জনরা এক্সপ্লোর করিনি, সেটা করতে চাই। যেটা আমি এরই মধ্যে করেছি, সেটা আর করতে চাই না। আমার সব সময় ইচ্ছা থাকে, যে বিষয়ের সঙ্গে জড়িত থাকব, সেটা যেন অবশ্যই প্রগ্রেসিভ বিষয়বস্তু হয়। সচেতনভাবে এটা করি। মানুষকে পিছিয়ে দেওয়া নয়, এগিয়ে দেওয়ার কাজটাই করি। আমাকে প্রোপাগান্ডা ছবিতে খুব একটা পাবেন না। (হাসি)
নতুন কি এক্সপ্লোর করতে চান...
পাওলি দাম : হরর কমেডি করতে চাই। অ্যাকশন কমেডির প্রতিও একটা দারুণ আগ্রহ আছে। গত বছর কমলেশ্বর মুখার্জির একটা ছবি করেছি, একটু সরে বসুন, ইটজ আ স্যাটায়ার অলসো। ওই জনরা আমি বাসু চ্যাটার্জির সঙ্গে বহু বছর আগে করেছি, হচ্ছেটা কি, তারপর কমেডি এটাই করেছি। তিন-চার বছর ধরে বাংলা ইন্ডাস্ট্রি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আর বড় মাপের কাজ করতে গেলে, আরও ভালো কাজ করতে গেলে, দর্শকদেরও সিনেমা হলে আসতে হবে।
দর্শক তো আসছেন...দর্শক বুঁদ হয়ে থাকবেন, তেমন কনটেন্ট আমরা দিতে পারছি?
পাওলি দাম : সেটাও বড় প্রশ্ন। এটা ঠিক, দর্শক আছেন। তবে বাংলা কনটেন্ট আরেকটু পুশ করতে হবে মনে হয়। আমার দিক থেকে এ-ও মনে হয়, বিষয় ও কনটেন্ট ওয়াইজ আমরা যেন আরেকটু সেফ খেলতে পারি। একটা কনটেন্ট ক্লিক করল মানে ওই ধরনের কাজই করে যাব, তা হয় না। মাধবীলতা আমার প্রিয় চরিত্র, এমন চরিত্র আর লেখা হয়নি। সিনেমা তো আমরা বহু সাহিত্য থেকেও করেছি। আমরা কি সে রকম অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারছি, তাহলে সিনেমা কীভাবে হবে। এগুলো বললে তো আবার ....
আপনি মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা যেমন করেছেন, তেমনি দেখা গেছে শৈল্পিক ধরার সিনেমাতেও। আপনার কী মনে হয়, দুই ধারার সিনেমায় সমন্বয় করে চলছে পেরেছেন? আপনার সিনেমা বাছাই নিয়ে কী আপনি পুরোপুরি সন্তুষ্ট?
পাওলি দাম : সিনেমা বাছাই নিয়ে আমি পুরোপুরি সন্তুষ্ট। আমি সব সময় সেরা কাজটা বাছাই করেছি। আমার সামনে ১০টা কাজ থাকলে সেখান থেকে ২-৩টা বাছাই করেছি। বাকিগুলো যে আমি পছন্দ করিনি, সেসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। আমি অনেক বৈচিত্র্যময় কাজ করতে পেরেছি। সুযোগও পেয়েছি। গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালকও পেয়েছি। ওই ধরনের অসাধারণ লেখা, ওই রকম পরিচালক আমায় এনে দাও—আমি সব করতে রাজি আছি।
গত কয়েক বছরে আপনার কাজের সংখ্যা অনেক কম। এটা কি সচেতনভাবেই করেছেন?
পাওলি দাম : একদমই সচেতনভাবে করেছি। আমি সিনেমায় গত দেড় বছরে অনেক বেশি না বলেছি, হ্যাঁ বলার চেয়ে। তার কারণ, আমাকে কনটেন্টগুলো টানছিল না। যে রকম পরিচালকের সঙ্গে কাজ করে আমার জার্নি তৈরি হয়েছে, সে রকম দর্শনের পরিচালক এবং লেখকও আমাদের দরকার। সো, উই নিড গুড রাইটার ফার্স্ট অব অল। নিঃসন্দেহে পরিচালক তো তৈরি হবেনই, আমাদের ভালো লেখকও দরকার। দর্শকের সমর্থনও দরকার। তবেই আমাদের বাজেট আরও বাড়বে, আমরা বেশি সুযোগ পাব।
অনেকে এমনটাও মনে করেন, বলিউডে মনোযোগ দিতে গিয়েই বাংলায় কাজ কমিয়ে দিয়েছেন অভিনেত্রী। এ প্রসঙ্গে পাওলি কী বলেন?
পাওলি দাম : সত্যি কথা বলতে, আমি সব ভাষার কাজ করতে চাই। এখন যদি আমাকে কেউ বলেন টার্কিশ ছবি করতে, তা-ও রাজি আছি। শুধু আমায় ভাষাটা শিখতে হবে। আমি বিভিন্ন ভাষার কাজ দেখি। আন্তর্জাতিক কাজ বরাবরই করতে চেয়েছি। বাংলা কাজ করছি, করব। আমি কিন্তু বলিউড থেকে ডাক পেয়েছিলাম। বিষয়টা এ রকম নয়, গিয়ে কাজ খুঁজেছি। বিশ্বের যেকোনো ভাষায় কাজ করার ডাক পেলে আমি ছুটে যাব। আমার কাছে ভাষা কখনোই বাধা ছিল না। আজকের দিনে বহু মানুষ এটা বলবেন, কারণ ওটিটি। আমি বরাবরই বলেছি, অভিনয়শিল্পী হিসেবে সব ভাষায় নিজেকে এক্সপ্লোর করতে চাই। তার জন্য আমার এখানে কনটেন্ট কম, বিষয়টা মোটেও এমন নয়। আমি এটার বাইরেও গিয়ে অনেক কনটেন্ট করতে চাই।
এখন যে এত কনটেন্ট, এটা কি অনেক বেশি মনে হয় আপনার? ২০১০-এর পর আপনার অভিনীত ‘কালবেলা’, ‘এলার চার অধ্যায়’, ‘তখন ২৩’, ‘ক্ষত’—এর মতো কনটেন্ট এখন হয় না। অনেক বেশি কনটেন্টের কারণে আমরা কি অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক হয়ে গেছি? ওটিটি আসার আগে অনেকে এমনও ভেবেছিলেন, স্বাধীনভাবে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা আরও বেশি কাজ পাবেন। ঘটনা হয়েছে উল্টো। ওটিটি আরও বেশি থ্রিলার, বাণিজ্যিক...স্বাধীন নির্মাতারা সংকুচিত হয়েছেন?
পাওলি দাম : ‘কালি’ ছিল ওটিটিতে আমার প্রথম কাজ। তার আগে কোনো কনটেন্ট ভালো লাগেনি। আমি কোনো দিন ‘দুপুর ঠাকুরপো’ করতে চাই না, আই অ্যাম সরি। আমার ভাবনা, চিন্তা ও দর্শনের সঙ্গে যায় না, এমন কাজ আমি করবই না। আমি কারও বিপক্ষে বলতে চাই না। আমি সমৃদ্ধ কনটেন্ট তৈরি করতে চাই। এটা নির্ভর করছে কোন দর্শককে আমরা ক্যাটার করছি। আমি যদি একটু ভালো দর্শক তৈরি করতে চাই, তাহলে সমৃদ্ধ কনটেন্ট বানাতেই হবে। গত ৫ বছরে ওটিটিতে লোকাল কনটেন্ট যা হচ্ছিল, তা আমাকে টানছিল না। তাই তার থেকে ভালো কনটেন্ট হিন্দিতে করেছি। অবশ্যই আমি সেটা করবও। আমার মনে হলো, যেহেতু আমি বাংলা থেকে কাজ শিখেছি, সেখান থেকে বলিউডে গেছি—আমার দায়বোধও আছে। তবে এটা ঠিক, ওটিটি যখন চালু হয়েছিল, তখন অনেক ভালো ভালো স্বাধীন নির্মাতা কাজ করেছেন, এক্সপেরিমেন্টের জায়গাও ছিল। আস্তে আস্তে সবাই একটা ফ্যাক্টরি জায়গায় চলে আসছি। প্রোডাকশন ডিজাইনিং হয়ে গেছে। ওই ডিজাইনিংগুলো যত একই রকম হতে থাকবে, ততই মনে হবে, কনটেন্ট অনেক বেশি তৈরি হচ্ছে। এর বাইরে যদি অর্গানিক্যলি কিছু কাজ অ্যাপ্রোচ করি, তাহলে এই অনুভব হবে না।
আপনার দৃষ্টিতে সমৃদ্ধ কনটেন্ট কী?
পাওলি দাম : আমি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। আমি ভাবতে থাকি, একটা মানুষকে প্রগ্রেসিভ স্পেসে নিয়ে যাব। সমৃদ্ধ কনটেন্ট, যেমন নারকোস, গেম অব থ্রোনস, লার্জার দেন লাইফ কনটেন্ট—যেটা মানুষকে একটু নাড়া দেবে, ভাবাবে, মুগ্ধ করবে, ভালো লাগবে, ভালোবাসা তৈরি করবে। মননের একটা উন্নয়ন ঘটবে। ইউনিক একটা কিছু হবে। জনপ্রিয়তা এবং শৈল্পিক জায়গা দুটি দুই ধরনের বিষয়। একজন শিল্পী কোনটি বেছে নেবেন, সেটা তাঁর নিজস্ব ভাবনাচিন্তা। কেউ হয়তো চাইবেন, আমার শৈল্পিক জায়গা হয়েছে, এখন আমি জনপ্রিয়তাও চাই। এটাতে ভুল কিছুই দেখি না। আবার আমি জনপ্রিয়তা পেয়েছি, এবার স্বাধীন মাধ্যমটাও চাই—এমনটাও হতে পারে। যার জন্য দেখা যায়, অনেক অভিনেতা বিভিন্ন জনরায় কাজ করতে চান, যেটা আমি সব সময় চেয়েছি। আমি জনপ্রিয় কাজ যেমন করেছি, শৈল্পিক কাজও করেছি—এই সমন্বয় রক্ষা করার চেষ্টা করেছি।
এখন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়, দর্শকের চাহিদার কথা ভেবে কাজ করেছি। আবার কেউ বলছেন, মনের মতো গল্প পেয়েছি, তাই করলাম। শিল্পী কি তবে দর্শক চাহিদায় নাকি নিজের মনের চাহিদায় কাজ করবেন?
পাওলি দাম : দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পী যেমন চাইছেন, সেটা যেমন আছে; তেমনি দর্শক যে চাইছেন, সেখানে নতুন কি দিতে পারছি বা সেটার থেকেও অতিক্রম করতে হবে। তাতে দর্শকের আশাটাও মিটল, আমারও মনের চাহিদা পূরণ হলো।
‘কালবেলা’ দেখে আপনাকে মৃণাল সেন ফোন করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা বলুন। মৃণাল সেনের সঙ্গে কাজ করতে না পারায় আক্ষেপ হয়?
পাওলি দাম : আক্ষেপটা কিছুটা হলেও মিটছে পালান করে। কৌশিকদার (গাঙ্গুলি) সঙ্গে এই একটাই কাজ করা। পালান ট্রিবিউট টু মৃণাল সেন। কালবেলার পর মৃণালদা যখন আমায় ফোন করেছিলেন, তখন একটা শুটিং সেটে বসেছিলাম। অপরিচিত নম্বর থেকে কল এল, আমায় বলছেন, ‘মৃণাল সেন বলছি।’ প্রথমে বুঝতে সময় লেগেছে। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপর দেখা করতে গেলাম। অনেক কথা হলো। কাজ নিয়েও কথা হলো। শেষ আলাপের পর একটা কথা বলেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো দিন ছবি করি পাওলি, তুমি করবে?’ এটা শোনার পর মনে হচ্ছিল, কী বলেন উনি! যা-ই হোক, উনার বয়স হয়েছিল, আস্তে আস্তে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেখা বহুবার হয়েছে, কাজ হয়নি। আমিও তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি, হয়নি। কিন্তু মৃণাল দার ট্রিবিউটে যে ছবিটা হলো, কৌশিকদা বানালেন, আমি সেটার অংশ। আমার পক্ষ থেকে এটা তাঁর প্রতি ট্রিবিউট।
এখন তো কলকাতার শিল্পীরা ঢাকায়, ঢাকার শিল্পীরা কলকাতায় নিয়মিত কাজ করছেন। এটা বাংলা কনটেন্টে কতটা বৈচিত্র্য বাড়াবে?
পাওলি দাম : বৈচিত্র্য তো বাড়া উচিত। অবশ্যই উচিত। অসাধারণ কনটেন্টের জন্য অভিনয়শিল্পীর পাশাপাশি লেখকদেরও আদান-প্রদান হওয়া উচিত। পরিচালকদেরও উচিত। এখানকার পরিচালক, লেখক ওখানে গিয়ে কাজ করুন, ওখানকার পরিচালক, লেখকেরাও এখানে আসুন। শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও নন, বদলটা কিন্তু তখনই হবে, যখন ক্যামেরার পেছনের মানুষদেরও যাওয়া-আসা হবে।