ছবি : প্রথম আলো
ছবি : প্রথম আলো

তখন কিন্তু যারা না শিখে গান করত, কিছুটা কুণ্ঠিত থাকত: অদিতি মহসীন

রবীন্দ্রসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী অদিতি মহসীন। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে তিন দিনব্যাপী একটি সম্মেলনে অংশ নিতে ১ জুলাই উড়াল দিচ্ছেন। কলকাতা থেকে একক অনুষ্ঠান শেষ করে এসেছেন। এদিকে মাছরাঙা টেলিভিশনে শুরু হচ্ছে তাঁর উপস্থাপনায় অনুষ্ঠান ‘পরম্পরা’। এসব নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বললেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

শুনলাম, শিকাগোতে একটা সম্মেলনে অংশ নিতে যাচ্ছেন।

অদিতি মহসীন : নর্থ আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনে অংশ নিচ্ছি। ৪, ৫ ও ৬ জুলাই তিন দিনব্যাপী সম্মেলন। বাংলাদেশ থেকে চঞ্চল চৌধুরীও যাচ্ছে।

প্রশ্ন

পৃথিবীর অনেক দেশে গান করতে গেছেন। অনেক সম্মেলনেও অংশ নিয়েছেন। এই সম্মেলনের বিশেষত্ব কী বলে মনে করছেন?

অদিতি মহসীন : এটা ঠিক, অনেক দেশে অনুষ্ঠান করেছি। তবে এটা বিশেষ এই কারণে, এ নিয়ে ৪৪তমবার আয়োজন হচ্ছে করা এই সম্মেলন। নর্থ আমেরিকার বাংলা গানের জন্য সবচেয়ে বড় আসর। নর্থ আমেরিকাতে তো প্রচুর বাঙালি থাকেন, বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিও। দেখা যায়, প্রতিবছর পাঁচ-ছয় হাজার দর্শক থাকেন। এত মানুষের একটা সম্মিলন, অনেক শিল্পীর একটা সম্মিলন, সবকিছু বাংলা সংস্কৃতিতে ঘিরে—এটা বিশেষ ভালো লাগার ব্যাপার।

প্রশ্ন

এর আগেও কি এই অনুষ্ঠানে গিয়েছেন?

অদিতি মহসীন : এর আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। শেষ গিয়েছিলাম ২০১৮ সালে, নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটিতে।

প্রশ্ন

এ ধরনের সম্মেলন থেকে আমরা কীভাবে লাভবান হচ্ছি বলে মনে করেন আপনি?

অদিতি মহসীন : আসলে বিদেশের জন্য তো এগুলো দরকার। বিশেষভাবে দরকার। সেটা অনুধাবন করেই হয়তো উদ্যোক্তারা এমন আয়োজন করে থাকেন। শুধু বাংলা গান নয়, বাংলা সংস্কৃতির নানা শাখার সবকিছুই ওখানে থাকে। নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, গান—সবই। হয়তো নতুন প্রজন্ম, যারা ওই দেশে বড় হয়, তারা যেন কিছুটা বাংলা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়, সেই চিন্তা মাথায় রেখেই হয়তো আয়োজকেরা শুরু করেছিলেন। আমি মনে করি, এটা শুধু বিদেশ নয়, আমাদের দেশেও যদি হয়, নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে। তাই শুধু বিদেশের জন্য নয়, এমন সম্মেলন দেশের জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

অদিতি মহসীন
প্রশ্ন

বাংলাদেশে কি এ ধরনের সম্মেলন কম হয়?

অদিতি মহসীন : আমাদের তো সম্মেলন সে রকম হয়ই না। আমাদের যেটা হয়, বছরে একটা রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন হয়। ইদানীং নজরুলসংগীত সম্মেলন হয়তোবা হচ্ছে। এসব কিন্তু শিল্পীরা উদ্যোগ নিয়ে করছেন; কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ তো শুধু শিল্পীদের নয়, অন্যদেরও নেওয়া উচিত। পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ও সরকারের আরও আয়োজন থাকা উচিত।

প্রশ্ন

শুনলাম, এর মধ্যে কলকাতায় দারুণ একটি শো করেছেন...

অদিতি মহসীন : এটা বড় একটা একক অনুষ্ঠান ছিল। ২৩ জুনের এই অনুষ্ঠান বালিগঞ্জের বিড়লা সভাঘর হয়েছে। খুবই চমৎকার অনুষ্ঠান, মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। এই অনুষ্ঠানের টিকিট মাসখানেক আগেই বিক্রি হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের অর্ধেক সময়ে আমি রবীন্দ্রসংগীত গেয়েছি। বাকি সময়ে তিন কবির গান গেয়েছি। হাজারখানেক দর্শকের সামনে আড়াই ঘণ্টা গেয়েছি।

প্রশ্ন

অনুষ্ঠানের আগে সব টিকিট বিক্রির ব্যাপারটি অনুভূতির ব্যাপার ছিল?

অদিতি মহসীন : ভারত যত–না বলব, কলকাতার ক্ষেত্রে একটা কথা বলতে পারি, এমনকি অনেক বড় বড় শিল্পীকেও বলতে শুনেছি—কলকাতা গানবাজনার দারুণ জায়গাও। শ্রোতারাও বেশ সমঝদার। তবে আমাদের দেশেও ভালো শ্রোতা আছেন। কিন্তু বছরের পর বছর আমরা তাদের তৈরিও করছি না। আমাদের দেশে পাবলিক ফাংশন সেভাবে হয় না। চাইলেই টিকিট কেটে যে কেউ একটা অনুষ্ঠানে যাবে, তেমন সুযোগটা নেই। মূলত ক্লাবভিত্তিক এবং করপোরেট এ ধরনের অনুষ্ঠান এখানে বেশি হচ্ছে—সেখানে সাধারণ শ্রোতা যারা, তাদের যাওয়ার সুযোগ নাই।

অদিতি মহসীন
প্রশ্ন

আমাদের দেশে টিকিট শো কতটা হওয়া উচিত বলে মনে করছেন?

অদিতি মহসীন : আমাদের অনেক বেশি হওয়া উিচিত। আজকাল দু–একটা দেখছি, সেটাও বেশির ভাগ বিদেশি শিল্পী এসে হয়তো করছেন। আয়োজক প্রতিষ্ঠান যারা আনছেন, সেখানে অনেকটা ব্যবসায়িক দিকটাই বেশি থেকে। শ্রোতা যে আমাদের আছে, সেই শ্রোতারা যে তাঁদের পছন্দমতো অনুষ্ঠান সব সময় পাচ্ছেন না, সেদিকটায় আমাদের নজর দেওয়া দরকার। আমাদের দেশে শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসব, ফোক ফেস্টিভ্যালের দিকে তাকালেও দেখি, রাতভর তীব্র শীত উপেক্ষা হাজার হাজার মানুষ গান শুনছেন। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ যাচ্ছেন সেসব অনুষ্ঠানে, তার মানে শ্রোতা যে আছেন, এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো আমি বিশ্বাস করি, আমাদের ভালো শ্রোতা এখনো আছেন। তাঁরা আসলে তাঁদের পছন্দমতো বা রুচিমতো, যাওয়ার মতো অনুষ্ঠান পাচ্ছেন না।

প্রশ্ন

বলছিলেন, মাছরাঙায় ‘পরম্পরা’ নামে নতুন একটা অনুষ্ঠান করছেন?

অদিতি মহসীন : টেলিভিশন তো এখন কম দেখেন মানুষ। তারপরও মাছরাঙা টেলিভিশনে নতুন আরেকটা অনুষ্ঠান শুরু করেছি। এটা গুরু-শিষ্যের পরম্পরা নিয়েই। গান তো গুরুমুখী বিদ্যা, এটা তো আমরা সব সময় বলিও। এই যে গুরুর কাছে কীভাবে গান শিখছেন, সব প্রজন্মের শিল্পীর শেখার পদ্ধতিটা কীভাবে হয়েছে, সেটা নিয়েই মূলত অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে গুরু-শিষ্য দুজনেই থাকছেন। তাই দুই প্রজন্মের ভাবনা–চিন্তা জানতে পারছি।

অদিতি মহসিন তানপুরা দিয়ে রেয়াজ করেন প্রতিদিন। ছবি: সুমন ইউসুফ
প্রশ্ন

এ ধরনের অনুষ্ঠান স্বার্থকতা কোথায় মনে করছেন?

অদিতি মহসীন : যারা এখন নতুন গান করছে, তাদের জন্য এই অনুষ্ঠান কিছুটা সহায়ক হতে পারে বলে আমি মনে করি। আসলে গানবাজনা না শিখে করার যে কোনো সুযোগ নাই, সেটার ক্ষেত্রে আমরা যদি একটু সচেতনতা তৈরি করতে পারি আরকি। আগে কিছুদিন এই অনুষ্ঠান চলেছিল, এই জুলাই থেকে আবার শুরু হবে, নতুন আঙ্গিকে।

প্রশ্ন

আপনি বলছিলেন, এখন না শিখে গান করার প্রবণতার কথা। আগেও এমনটা ছিল নাকি এখনকার মতোই। নাকি এখন অতিরিক্ত প্রচারণার কারণে না শেখা ও না জানারা বেশি আলোচনায় আসছেন?

অদিতি মহসীন : না শেখারা আগেও ছিল, কিন্তু এতটা ফোকাসড ছিল না। প্রচারযন্ত্র কখনোই এতটা মেতে থাকত না। তখন কিন্তু যারা না শিখে গান করত, কিছুটা কুণ্ঠিত থাকত। আমার তো সেভাবে শেখার সুযোগ হয়নি, এই কথাটা বলত। কিন্তু এখন তো যেন এটাই প্রথা হয়ে গেছে, না আমি তো কোথাও শিখিনি বা শিখি নাই বলে আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমি গান গাচ্ছি, প্রোগ্রাম পাচ্ছি, যথেষ্ট টাকা রোজগারও করছি। সুতরাং আমার না শিখলে, যে শিখে গান করছে বা না শিখে গান করছে—তার মধ্যে তফাত খুব একটা করা যাচ্ছে না। এটা তো ভালো না। গানবাজনার যে সঠিক গুণমানের বিচার, এটাও তো একটু কমে গেছে, যে কারণে সাধারণত শ্রোতারাও অনেক সময় বুঝতে পারছে না যে আসলে ভালো গান এবং খারাপ গানের মধ্যে সূক্ষ্ম তফাত। প্রচার–প্রসারটা দেখে শ্রোতারাও হয়তো বুঝছে যে ঠিক আছে, তারাই হয়তো বড় শিল্পী। প্রচারমাধ্যমের উচিত, কাকে কতটা প্রচার দিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবা, অশিল্পী ও অসংস্কৃতিমনা মানুষ তৈরির দায় তাদেরও আছে। তাই ভেবেচিন্তে প্রচার দেওয়া উচিত।

অদিতি মহসিন
প্রশ্ন

নতুন গান প্রকাশ করবেন?

অদিতি মহসীন : একক কিছু গান তৈরি হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হবে।