বাংলাদেশি অভিনয়শিল্পী মোশাররফ করিমের অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী। মোশাররফ করিমের কাছে তাঁর ‘প্রণাম’ পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধও করেন। সম্প্রতি শেষ হওয়া ঢাকা লিট ফেস্টের এক সন্ধ্যায় কবিতাবিষয়ক একটি সেশনে বক্তব্যের এক ফাঁকে দেশের এই অভিনয়শিল্পীর প্রশংসা করেন তিনি। কবি শামীম রেজার সঞ্চালনায় বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে ‘মুখোমুখি’ শিরোনামে ওই আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। আজ শুক্রবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে মোশাররফ করিমকে নিয়ে লেখা জয় গোস্বামীর কবিতা। আলাপে তিনি জানিয়েছেন দেশের এই অভিনয়শিল্পী সম্পর্কে তাঁর ভালো লাগার অনুভূতিও। এসব নিয়ে আজ শুক্রবার বিকেলে কথা হয় মোশাররফ করিম–এর সঙ্গে।
প্রথম আলোয় আপনাকে নিয়ে জয় গোস্বামীর লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। নিশ্চয় পড়েছেন? কেমন লেগেছে?
আমি কী বলব! লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি। মাথা নুয়ে যাচ্ছে। আমার কাছে যদি জানতে চাওয়া হয়, জীবনে যতবার বিস্মিত হয়েছি, তার মধ্যে এটি শ্রেষ্ঠতম। আজকে যখন প্রথম আলোয় আমাকে নিয়ে কবিতাটা ছাপা হয়েছে, দেখলাম। ভালোই লাগছে। অনেক ভালো লাগছে। এই ভালো লাগার সত্যিকারের অনুভূতি আসলে প্রকাশ করব কীভাবে, জানি না। জয় গোস্বামীর কবিতা যেকোনো পত্রিকা প্রকাশ করতে উন্মুখ হয়ে থাকবে। আমার জন্য ভালো লাগা হচ্ছে, আমাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা, সেটা প্রথম আলো যত্ন নিয়ে ছেপেছে। এটার জন্য ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ। এই কবিতা কিন্তু তিনি আমাকে দিয়ে গেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। কবিতাটা তিনি লিখিত আকারে উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁর হাতে লেখা এই কবিতা এখন আমার কাছে। এই উপহারের কোনো মূল্য হয়! অমূল্য।
তার মানে আপনাদের দেখা হয়েছিল?
দেখা হয়েছিল। ১১ জানুয়ারি আমাদের দেখা হয়। উত্তরায় একটি কফি শপে। আমরা একসঙ্গে আধা ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। আমার জীবনে যতবার বিস্মিত হয়েছি, তার মধ্যে এই ঘটনা অন্যতম। আমি ভীষণ অবাক হয়েছি, আমার নাটকের, সিনেমার সংলাপ ওনার মুখস্থ। সেটা তিনি আবার অ্যাক্টিং করে দেখাচ্ছেন। আমি বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। হতবিহ্বল হয়ে গেছি। ‘মহানগর’–এর সংলাপ, ‘দাগ’–এর সংলাপ, সঞ্জয় সমদ্দারের ‘অমানুষ’–এর সংলাপ এবং একটা মুহূর্তের কথাও বললেন। আমি তো অবাক। তিনি অনেক ডিটেইল দেখেন। ‘দানব’ নামে একটা নাটক করেছিলাম, সেটাতে মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার সময় লুকটা কেমন ছিল, তা–ও বললেন এবং সেগুলো ব্যাখার পর্যায় দিয়ে তিনি বলছিলেন। শুধু ভালো লেগেছে তা নয়, কেন ভালো লেগেছে, কেন তাঁর কাছে আলাদা মনে হয়েছে, সেই বিষয়গুলো নিয়েও কথা বলেছেন। আধা ঘণ্টা অসাধারণ সময় কেটেছে। অসাধারণ!
আপনাদের আড্ডায় আর কে কে ছিলেন?
আমি একাই ছিলাম। এমনিতে আমি কয়েক দিন ধরে রাত জেগে শুটিং করছিলাম। শুটিং শেষ হতে ভোর। কয়েক দিনই ভাবছিলাম, জয় গোস্বামীর সঙ্গে দেখা করব। দেখা করব। ভোরে বাসায় গিয়ে তখন তো ঘুমাতেই হয়। ঘুম থেকে উঠে আবার দেখি যে শুটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। এভাবেই চলছিল। ১১ জানুয়ারি ভাবলাম, দেখা করবই। কবি শামীম রেজাকে ফোন দিলাম, বন্ধু মানুষ। তার ওখানেই তো ছিলেন জয় গোস্বামী। শামীম বলল, ‘দোস্ত, উনি তো রওনা দিয়ে দিয়েছেন।’ বললাম, কোথা থেকে? আমি ভাবছি, ফ্লাইটে উঠে গেছেন। তখন বলল, ‘না, আমার এখান থেকে বের হয়ে গেছেন।’ আমিও ভাবলাম, বিমানবন্দর গেলে তো উত্তরার জসীমউদ্দীন হয়ে যাবেন। এরপর আমিও বাসা থেকে রওনা দিচ্ছি। এরপর আমাদের দেখা হলো, উত্তরার বিনস অ্যান্ড অ্যারোমা সেন্টারে। এই দেখাটুকু না হলে মিস করতাম। আফসোসই লাগত।
তিনি যে আমার অভিনয় পছন্দ করতেন, আগে থেকেই জানতাম। ফেসবুকে এক ভদ্রলোক লিখেছিলেনও, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী বোধ হয়, তাঁর বাসায় উনি গিয়েছিলেন। তাঁর কাছে উনি আমার কথা খুব বলেছিলেন। সে আবেগের মাত্রা এ রকম ছিল বলেই সেই ভদ্রলোকও আমাকে জয় গোস্বামীর বিষয়টি লিখেছিলেন আরকি। আমার তো বরাবরই স্বভাব যে প্রচার করতে ভালো লাগে না। চিন্তা করছিলাম যে কলকাতায় গেলে টুক করে দেখা করে আসব। বাংলাদেশে বসে যে দেখা হলো, ভালোই হলো। আড্ডায় তাঁর স্ত্রীও ছিলেন।
কী নিয়ে আপনাদের কথা হলো?
মেইনলি আমার অভিনয় নিয়ে উনি কথা বলেছেন। অন্যদিকে প্রসঙ্গ সরাতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। আমার প্রতি তাঁর ভীষণ আবেগ আমাকে মুগ্ধ করেছে। ইট আ গ্রেট গিফট, কবিতাটা। আমি তাঁকে বলেছিও। কবিতাটা বাসায় বাঁধিয়ে রাখব।
দুই দেশের শিল্পাঙ্গনের দুটি ভিন্ন মাধ্যমের বাসিন্দা আপনারা। শিল্পকর্মই আপনাদের ভালোবাসায় বেঁধেছে। ব্যাপারটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
অনেক কিছুই তো আমরা লেজেগোবরে করে ফেলি। অশিল্পকেও শিল্প বানিয়ে ফেলি। আবার শিল্পকে চিনিও না। সত্যিকারের শিল্পচর্চা যাঁরা করেন, তাঁদের খবরও নিই না। শিল্পী মানেই তো আসলে লয় হয়ে যাওয়া মানুষ, ডুবে যাওয়া মানুষ। কবি হলে কবিতার মধ্যে লয় হয়ে যাওয়া মানুষ, পেইন্টার হলে পেইন্টিংয়ে, অভিনেতা হলে অভিনয়ের মধ্যে—এ রকম গভীর অনুভূতিগুলো যাঁদের মধ্যে আছে, এ রকম লয় হয়ে যেতে পছন্দ করেন, হারিয়ে যেতে পছন্দ করেন, ডুবে যেতে পছন্দ করেন, সে রকম মানুষের জাত তো আসলে একটিই। উনিও ডুবে যেতে পছন্দ করেন, আমিও ডুবে যেতে পছন্দ করি। এই মানুষগুলোর জাত তো এক। শুধু পাশের দেশের নয়, এমন কোনো দেশ, যাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, শুধু শিল্পকর্ম দিয়েই তাঁদের যোগাযোগ হতে পারে। আত্মার সম্মিলনও হয়।
জয় গোস্বামী আপনার অভিনয়ের প্রশংসা করলেন। গভীরভাবে আপনার অভিনয়ের পর্যবেক্ষণও করেছেন বলে জানালেন আপনি। পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় এই কবির সাহিত্যের সঙ্গে আপনার পরিচয়টা কবে থেকে, যদি বলতেন?
সময়, কাল তো বলতে পারব না। তবে তরুণ বয়সে পরিচয়, এটা ঠিক। তাঁর লেখা প্রথম কবিতা নয়, একটা উপন্যাসই পড়ি, যেটার নাম ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’। খুব অল্প বয়সেই পড়েছি। সত্যি বলতে, চাপাবাজি করলে তো হবে না, তাঁর উপন্যাস ও কবিতা যে খুব বেশি পড়েছি, তা নয়। তবে যা পড়েছি, তাতে তাঁর লেখার প্রতি মুগ্ধতা তো আছে। ‘বেণীমাধব’ যে গান হলো, এই কবিতা পড়তে গিয়ে তো কান্না পেয়েছে।
তিনি আপনার অভিনয়ের যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তা আপনাকে অবাক করেছে। তাঁর লেখা আপনি পড়েছেন। অন্য অনেক লেখকের লেখাও পড়েছেন। তিনি আপনার দৃষ্টিতে কেন অনন্য?
আমি শুধু ওইটুকুই বলতে পারব, তাঁর লেখার ব্যাখা–বিচারের কথা বলতে চাইছি না, বলার ক্ষমতাও আমার নেই আসলে—এটা পরিষ্কার কথা। লয় হওয়া, মিশে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া মানুষকে টের পাওয়া—সেটা তো তাঁর কবিতার মধ্যে পাওয়া যায় এবং এবার দেখা হওয়ার পর কেন তিনি এমন লিখতে পারেন, সেটাও ফিল করতে পারলাম। আমরা পরস্পর আলিঙ্গন করেছিলাম, গভীর আলিঙ্গনই। নিখাদ আলিঙ্গন। একদমই ভালোবাসার, প্রেমের আলিঙ্গন।