আজ ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আজ সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটে আরটিভিতে এই রাত তোমার আমার অনুষ্ঠানে গাইবেন অদিতি মহসিন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কাল বৃহস্পতিবার ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানেও গাইবেন তিনি। একই দিনে এটিএন বাংলায় সরাসরি অনুষ্ঠানে গান শোনাবেন। নতুন প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীতচর্চা ও সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর সঙ্গে বলেন মনজুর কাদের
শুরুতে একটা কথা জানতে মন চাইছে। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় কবিগুরুর জন্মদিন কীভাবে পালন করতে দেখেছেন?
অদিতি মহসিন : শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান হতো না। কারণ, ওই সময়ে বিশ্বভারতীতে ছুটি থাকত, ২৫ বৈশাখের এই সময়ে ভীষণ গরমও থাকত। অতিরিক্ত গরমে ওই সময় শান্তিনিকেতনের ওখানে পানির স্তরও নিচে নেমে যেত। শিক্ষার্থীদের অনেক কষ্ট হতো। সে জন্য ১ মে থেকে গরমের ছুটি দিয়ে দেওয়া হতো। আর তাই ২৫ বৈশাখে কোনো আনুষ্ঠানিকতা হতো না। তবে আশ্রমে যাঁরা থাকতেন, তাঁরা মন্দিরে প্রার্থনা করতেন। এর বাইরে আর কোনো আনুষ্ঠানিকতা রবীন্দ্রজয়ন্তী ঘিরে হতো না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকার সময়েও হতে শুনিনি। আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখনো দেখিনি।
এখন যে জয়ন্তীর অনুষ্ঠান হয়, এটা থেকে আমরা কি উপকৃত হতে পারছি?
অদিতি মহসিন : বিশ্বব্যাপী যেখানে বাঙালিরা আছেন, সেখানেই রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়। এটার কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের সাহিত্যে বলি, সংগীতে বলি, আমাদের বাঙালিদের আত্মপরিচয়ে বলি—সবখানেই তিনি আছেন। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া তো বাঙালিরা অনেকটাই অসম্পূর্ণ। কারণ, আমরা যা-ই করি না কেন, যদি একটা বইয়ের নামকরণও করতে যাই, কোনো অনুষ্ঠানের নামকরণ করতে যাই—আমরা বরাবরই রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরি। সেই জন্যই হয়তো আমরা এখনো ১৬৩ বছর পরও আয়োজন সাড়ম্বরে পালন করছি। এতে আমরা সমৃদ্ধ হচ্ছি ঠিকই, তবে রবীন্দ্রচর্চা সঠিকভাবে হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। যদি প্রশ্ন করা হয়, পর্যাপ্ত কি না, আমি বলব, মোটেও নয়। রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট চর্চা হলে আমরা অনেক দিক থেকে সমৃদ্ধ হতে পারতাম।
কোন কোন দিক থেকে সমৃদ্ধ মনে হয়?
অদিতি মহসিন : আমরা তো বাঙালি। দিনের শেষে আমাদের আত্মপরিচয়টা হলো সবার ওপরে। আমাদের ধর্ম, গোত্র—এগুলো বাদ দিলে প্রথমেই তো আমরা বাঙালি। পরিপূর্ণ বাঙালি হতে হলে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া সম্ভব নয়। আমরা খুব ছোটবেলা স্কুলে ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ দিয়ে শুরু করেছি, তা-ই না। তারও আগে ছড়ার বইতে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ পড়েছি। রবীন্দ্রনাথকে তখন হয়তো আমরা জানতাম না, কিন্তু আমরা পড়ে পড়েই বড় হয়েছি। সে জায়গায় একটা শিশুর, মানুষের মনন গঠনের যে জায়গা, সেখানে শুধু জন্মদিনের দিন খুব হইচই করে একটা অনুষ্ঠান করলাম বা তাঁর প্রয়াণদিবসে একটা কিছু আয়োজন করলাম, তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। আমি মনে করি যে তৃণমূলে একদম মূলধারার সঙ্গে এটার সম্পৃক্ততা থাকা দরকার। শুধু রবীন্দ্রনাথ কেন, নজরুলসহ আমাদের বাঙালিদের মধ্যে বড় যত মানুষ আছেন, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের কথা, সেটা শিক্ষাব্যবস্থা বলেন, সমাজব্যবস্থা বলেন, রাষ্ট্রের মধ্যে—সবখানে রবীন্দ্রনাথের চর্চাটা আরেকটু বাড়ানো দরকার। বেশি হওয়া দরকার।
রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কী উদ্যোগ নেওয়া দরকার?
অদিতি মহসিন : আমি বরং বলব, রাষ্ট্রীয়ভাবেই তো কিছু কিছু হচ্ছে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একটা অনুষ্ঠান করে থাকে, তবে যথেষ্ট নয়। এটাও ঠিক, শুধুই রাষ্ট্রই করবে, এটা আমি মনে করি না। দেশের মধ্যকার বড় বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেরও এদিকটায় মনোযোগী হওয়া উচিত। সমাজ করবে। মিডিয়ার ভূমিকাও অনেক। তবে এটা ঠিক, রাষ্ট্র অনেক কিছু চাপিয়েও দিতে পারে। এটাও ঠিক, চাপিয়ে দিয়েই তো হয় না। এটা আসলে সমাজ থেকে ওঠে আসা দরকার।
নতুন প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীতচর্চায় আপনি কতটা সন্তুষ্ট?
অদিতি মহসিন : নতুন প্রজন্ম নিয়ে একটা কথা শুনি—রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত শোনে না। আমি মনে করি, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যায় তো শোনে। না হলে ছায়ানটে কেন চার-পাঁচ হাজার ছেলেমেয়ে পড়ছে! তবে না শুনলে শোনানোর দায়িত্বটাও আমাদের আছে। নতুন প্রজন্ম যে শোনে না, এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এটা মোটেও আমাদের জন্য কৃতিত্বের নয়। আমাদের জন্য লজ্জার। আমরা বাঙালিরা যদি আত্মপরিচয়টাকে ভুলে যাই, শিকড়টাকে যদি ভুলে যাই, তাহলে সে জাতির এগোনো কিন্তু কঠিন। রবীন্দ্রসংগীত যাঁরা চর্চা করছেন, সবাই যে খুব ভালো অবস্থায় আছেন, তা তো নয়। তাঁরা কেউ হয়তো ভালো করছেন। কিন্তু গানকে এ দেশে তো আসলে সবাই পেশা হিসেবে নিতে পারেন না।
এখন তো রবীন্দ্রসংগীতের ফিউশন হয়। কেমন লাগে শুনতে?
অদিতি মহসিন : ফিউশন হতে পারে, কিন্তু গানটাকে অক্ষত রেখে হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ তো চাননি তাঁর গানের বিকৃত উপস্থাপন হোক। এটা আসলে রবীন্দ্রনাথ কেন, কেউই তো চাইবেন না। গানটা ঠিক রেখে, অন্যান্য যন্ত্রের ব্যবহার তো আমরা করতেই পারি, তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানটা যেন রবীন্দ্রনাথের গান বলে চেনা যায়, এটাও খেয়াল রাখতে হবে।