ধ্রুব হাসান
ধ্রুব হাসান

‘ভিন্নমত বা দ্বিমতকে গ্রহণ ও সম্মান করতে হবে’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীদের অনেকে। নিজেরা তো ছিলেনই, কেউ চারপাশের সবাইকে সংগঠিত করার চেষ্টাও করেছেন। তাদের মধ্যে দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ প্ল্যাটফর্মের ধ্রুব হাসান এর সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁর কাছ থেকে আন্দোলনের শিক্ষা ও অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা শুনেছেন মনজুর কাদের

প্রশ্ন

আপনার লড়াই কি নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে ছিল নাকি সরকারের থাকা স্বৈরাচারী মনোভাব ও কার্যক্রমের বিরুদ্ধে?

ধ্রুব হাসান: দেখুন, একজন শিল্পী বা সংস্কৃতিমনা মানুষ হিসেবে আপনি বা আমি কোনো দলীয় লেজুড়বৃত্তি কখনো করতে পারি না। কারণ, এতে আপনি আপনার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলবেন। তা ছাড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, এই সত্যকে তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় যখন এই দল একটা স্বৈরতান্ত্রিক ও পরিবারতান্ত্রিক দল হয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, কথা বলা— একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের কর্তব্য। গত ১৫–১৬ বছরে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করা হয়েছে; শুধু দলীয়করণ নয়, সঙ্গে মোটা অঙ্কের পার্সেন্টেজের বিনিময়ে নিয়োগ–বাণিজ্য বা টেন্ডার–বাণিজ্য চলেছে। আগের সরকারগুলোও একই কাজ করেছে, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে এমন এক সিস্টেম বানাল, যেখানে দলীয় আনুগত্য ও চাটুকারিতা সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াল। এ শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্র নয়; ক্যানসারের মতো এ ব্যাধি সমাজের সব প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে পাথেয় করে জীবনে এগোতে চেয়েছি, আমাদের নিশ্বাসও বন্ধ হয়ে আসছিল, তারপরও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ভয়ে এক রকম চুপ ছিলাম। কিন্তু ছাত্রদের বুকে গুলি চালানোর পর, বিশেষ করে আবু সাঈদের মৃত্যু, সব ভয়কে এক ঝটকায় যেন দূর করে দেয়! আমরাও দলেবলে সরকারের ফ্যাসিবাদী, স্বৈরাচারী মনোভাব ও কার্যক্রমের বিরদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং সবাইকে দাঁড়াতে উৎসাহিত করলাম।

ধ্রুব হাসান
প্রশ্ন

আওয়ামী লীগের মতো দেশের এত পুরোনো একটি দলের এমন পরিণতি থেকে অন্য সব রাজনৈতিক দলের কোনো শিক্ষা নেওয়ার আছে কি? তাহলে সেটা কেমন মনে করেন।

ধ্রুব হাসান: আমি আশাবাদী মানুষ হলেও পুরোনো দলগুলো নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখি না। কারণ, রিফর্ম বা সংস্কার করতে হলে সবার আগে দরকার খোলা মন, যা এদের কারও আছে বলে আমার মনে হয় না। এরা ক্ষমতাকে জনগণের আমানত মনে করেন না; বরং নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পদ ভাবে। এত বছরে বাংলাদেশের জনগণ এদের সবার চরিত্র বুঝে গেছে, তাই এখন প্রয়োজন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী নতুনদের দল; যারা ক্ষমতাযন্ত্রকে টাকা বানানোর মাধ্যম হিসেবে মনে করবে না, নিজেদের অপরাধকর্মকে আইন দ্বারা লেজিটিমেসি দেবে না। আর পুরোনো দলগুলোকে টিকে থাকতে হলে তাদের শিখতে হবে নিজেদের ভুল থেকে, তা না হলে তাদেরও অদম্য তারুণ্যের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।  

প্রশ্ন

যে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের কাছে আপনার প্রত্যাশা।

ধ্রুব হাসান: আমরা সেই ’৯০ থেকে দেখছি, আমাদের গণতন্ত্র বারবার হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে। সবাই মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে কিন্তু মেয়াদ ফুরালে আর ক্ষমতা থেকে নামতে চান না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার করেও এই সমস্যার সমাধান করা যায়নি। আমাদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করতে হবে, যাতে সরকার পরিবর্তন হলেও এর কোনো দলীয়করণ না ঘটে। আসলে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এ জন্য ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে। অধ্যাপক ইউনূস একজন গুণী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ, যার তিন শূন্যের আইডিয়া বিশ্বজুড়ে আলোচিত ও প্রশংসিত। আশা করি, তাঁর নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার এই সমস্যার একটা উপায় বের করতে পারবে। আসলে পারতেই হবে, কারণ এই সুযোগ মনে হয় আগামী ৫০ বছরে আমাদের শেষ সুযোগ হতে যাচ্ছে। দ্রুত এই অরাজকতা, লুট, রাহাজানি, ভাস্কর্য বা শিল্পকর্ম ভেঙে ফেলার নারকীয় তাণ্ডব যেন অচিরেই বন্ধ হয়। আমরা সবাই যেন নতুন সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের আশু সংস্কারে হাত লাগাই।

ধ্রুব হাসান
প্রশ্ন

নানান মতের এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত?

ধ্রুব হাসান: দেশের অন্যান্য অঙ্গনের মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও দ্রুত সংস্কার জরুরি। বিশেষ করে এফডিসি, চলচ্চিত্র পরিবেশক ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর এখনই সময়। সেন্সরশিপ, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, অনুদান প্রথাসহ সবকিছুর সংস্কার জরুরি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা সময়ের দাবি। পাশাপাশি ভিন্নমত বা দ্বিমতকে গ্রহণ ও সম্মান করতে হবে। একে অন্যকে ব্যক্তিগত হিংসা থেকে রাজনৈতিক ট্যাগিং করা থেকে বিরত থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মজা করার অঙ্গন ভাবা বন্ধ করতে হবে, একে প্রকৃত অর্থে শিল্পের মর্যাদা দিয়ে অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তরুণদের সুযোগ করে দিতে হবে। মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সরকারের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনকেও দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে দেশ সংস্কারে সবাই এক থাকি। কর্মক্ষেত্রের এমন পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে নারীরা, শিশুরা, বয়স্করা এই অঙ্গনে নির্দ্বিধায় সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারে। সমাজের নানান স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করাটা জরুরি, এতে অনেক ভুল ধারণার অবসান হয়। পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ, জীবনবোধ জাগ্রত করে এমন সব গল্প তৈরির মাধ্যমে ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে নিরলস কাজ করতে হবে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে গণমানুষের অঙ্গন হয়ে উঠতে হবে। আর তা করতে পারলে আমরা একদিন সত্যিকারের সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাও পেয়ে যাব; নিজেদের গল্পগুলো একান্ত আমাদের হয়েও গ্লোবাল হয়ে উঠবে, বিশ্বের বুকে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। আমাদের আরও অনেক ড. ইউনূস দরকার।