গুরুতর হার্ট অ্যাটাকে বাংলাদেশ সময় ২৫ জুলাই ভোরে মারা যান ব্যান্ড তারকা শাফিন আহমেদ। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এর মধ্যে ২৯ জুলাই বিকেলে শিল্পীর মরদেহ ঢাকায় আনার প্রস্তুতি চলছে। পরদিন বাদ জোহর বনানী কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন বড় ভাই ও মাইলস ব্যান্ডের সদস্য হামিন আহমেদ। শনিবার সকালে মুঠোফোনে ভাই ও শিল্পী শাফিন আহমেদের কয়েকটি দিক নিয়ে হামিন আহমেদের সঙ্গে কথা বলেন মনজুর কাদের।
বড় ভাই হিসেবে ছোটবেলা থেকেই শাফিন আহমেদকে দেখছেন। গানে গানে আপনাদের একসঙ্গে দীর্ঘ পথচলা। আপনার কাছে যদি জানতে চাই, সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদ অনন্য যে কারণে তাহলে কী বলবেন।
হামিন আহমেদ : আমাদের বয়সের ব্যবধান তো এক বছরের। আমরা পিঠাপিঠি ছিলাম। শাফিন আমার থেকে এক বছরের ছোট হলেও ছোটবেলা থেকে আমাদের সবকিছু একসঙ্গেই ছিল। আমি যেখানে ছিলাম, সে ওখানে ছিল। সে যেখানে ছিল, আমি ওখানে ছিলাম। আমাদের বন্ধুমহলও কমন ছিল। সেই সূত্রে আমি মাইলসে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে সে–ও অটোমেটিক্যালি মাইলসে যোগ দেয়। এরপর মাইলসের যাত্রা তো সবারই জানা। শাফিন অনন্য এর প্রধান কারণ, সে সবকিছুতে খুব মিটিকুলাস ছিল, যেকোনো কাজ ডিটেইলসে করত। সব সময় কোনো কাজ শুরুর আগে ওর একটা প্রস্তুতি থাকত। অ্যাটেনশন টু ডিটেইল যেটাকে বলে, সেটাই ছিল শাফিন। কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নয়, সব সময় একদম ঠিকমতো ডিটেইলস কাজে বিশ্বাসী ছিল। কাজের প্রতি খুব আন্তরিক ছিল। কোনো ফাঁকিঝুঁকি ছিল না।
শিল্পী হিসেবে ওর প্রতিটি কাজে ডেডিকেশন ছিল দেখার মতো। দ্বিতীয় ব্যাপারটা হচ্ছে, যাঁরা গান শোনেন ও বোঝেন—তাঁদের কাছে বড় জায়গা করার কারণ, তাঁর গায়কি। অনেকে বলে, আমার মায়ের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য ছিল। এটা ঠিক, কিছু কিছু জায়গায় ভয়েস টোন, স্পেশাল কিছু জায়গায় মায়ের আদতে ছিল—এটাও অবশ্য তাঁর জন্মগতভাবে পাওয়া। তার বেজ প্লেয়িংও দারুণ ছিল, প্রতিটি গানের পেছনে যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করা।
বাজাতে হবে বলে বাজানো, এটা অবশ্য কখনোই আমাদের কারও মধ্যে ছিল না। ওরও বেজ বাজানোটা বিউটিফুলি গানের সঙ্গে মিশে যেত। গানের সঙ্গে কমপ্লিমেন্ট করে, ডিস্টার্ব করে না, এ রকম একটা অ্যাপ্রোচ সব সময় ছিল শাফিনের, সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে গানগুলোর বাজানোতে। এ রকম আরও অনেক কারণ আছে, যেটা শাফিনের বিশেষত্ব।
১৯৯৬ সালে মাইলস প্রথম দেশের বাইরে ট্যুর করে। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্টেজ শো করেছে। মাইলস তার পথচলায় বিশ্বসংগীতের অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। বিশ্বসংগীতের প্রেক্ষাপটে আপনাদের দৃষ্টিতে সংগীতশিল্পী শাফিন আহমেদ কেমন মনে হয়?
হামিন আহমেদ : শুরুতে বলতে হবে, আমরা বিশ্বসংগীত বলতে গেলে বলি, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের কথা। ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের নিজস্ব একটা বলয় তৈরি করা আছে, নিজস্ব শিল্পীরা সেই বলয়ের মধ্যে কাজ করে উপকৃত হওয়া, মেলে ধরাও দারুণভাবে করে—এটা তাদের বিরাট সুবিধা। তাদের কৃতিত্ব, এমন পদ্ধতি তারা সৃষ্টি করেছে। তারা তো পৃথিবী চালায়, সেটাও একটা ব্যাপার। তার মানে এই নয় যে তৃতীয় বিশ্ব বা দ্বিতীয় বিশ্বের যারা মিউজিক করে, তারা তাদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডে যারা কাজ করছে তারা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের সুবিধা পেয়ে বিশ্বে অনেক ব্যাপকতা হয়তো লাভ করছে। কিন্তু শুধু যদি সংগীতের প্রেক্ষাপটে কথা বলা হয়, তাহলে প্রথম কথা হচ্ছে, আমাদের উপমহাদেশ বা দ্বিতীয় বিশ্ব বা তৃতীয় বিশ্বের তারাও সমানভাবে মেধাবী, প্রতিভাবান।
এবার শাফিনের ব্যাপারে আসি, বাংলাদেশে প্রথম সারির যে কয়টা ব্যান্ড আছে, আমি মাইলসের কথা নির্দিষ্ট করে বলি, মাইলস অ্যাজ গুড অ্যাজ এনি ব্যান্ড ইন দ্য ওয়ার্ড, যাদের গান আমরা শুনি। গায়ক, গীতিকার এবং বেজ প্লেয়ার হিসেবে শাফিন পৃথিবীর যে কেউ, যে বা যারা ভালো কাজ করেছে তাদের সমান—এখানে দ্বিতীয় কোনো কথা নেই। আমি যদি এ–ও বলি, বাচ্চু (আইয়ুব) পৃথিবীর অন্য সেরা গিটার প্লেয়ার যেমন সে–ও সে রকম।
জেমসও সেরা—তারা যেমন, সেও সে রকম। আমিও আমার মতো। সবাই সবার মতো। কিন্তু কথা হচ্ছে, যারা ওই স্বীকৃতিটা পেয়েছে, অর্জন করতে পেরেছে, ওই জায়গাটায় যেতে পেরেছে, হোক বাংলাদেশ—হতে পারে আমাদের বাংলাদেশ থেকে ওই গানগুলো এখনো পশ্চিমা দেশের মেইন স্ট্রিম মিউজিকে ঢোকেনি। হতে পারে, তার মানে এই নয় যে কিছুটা কম আছে। শাফিন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের কারও চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
সহকর্মী ও সহযোদ্ধা হিসেবে যেমন ছিলেন শাফিন আহমেদ।
হামিন আহমেদ : আমাদের তো দীর্ঘ পথযাত্রা। এটা ৫-১০ বছরের নয়। বাংলাদেশে আমরা মাইলস একটা বিপ্লব সৃষ্টি করছিলাম। আমি অন্য কোনো ব্যান্ডের কথা বলছি না, নির্দিষ্ট করে মাইলসের কথা বলছি। কারণ, কথা হচ্ছে মাইলস ও শাফিনকে নিয়ে। কথা হচ্ছে, আমরা তো একটা ফুটফ্রিন্ট তৈরি করছি। এটার অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেক ধরনের পথ তৈরি করে নিতে হয়েছে। এটা শুধু গানের সৃষ্টির জন্য নয়, সবকিছুর জন্য পথ তৈরি করতে হয়েছে।
আমরা যত দিন কাজ করেছি—একসঙ্গে আঠার মতো ছিলাম, কাজ যখন করেছি তখন তো দেখেছি, হি (শাফিন) ওয়াজ এক্সিলেন্ট। সময়মতো মহড়ায় আসা, রেকর্ডিংয়ে আসা—এ ব্যাপারগুলো তো শাফিনের মধ্যে দারুণ ছিল। যেকোনো সমস্যায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা, সমাধানে সামনে থেকে কাজ করা।
ব্যান্ডকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা, বহু বছর ধরে যদিও আমার হাত ধরেই হয়েছে, এরপর যখন শাফিন যুক্ত হয়েছে, তখন তার একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সময় দেওয়ার ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো ছিল। কী করতে হবে, এটা এ রকম না করে ওরকম করলে ভালো হয়, তাহলে আমি এটা, আমি ওটা করি—এমনটি করত। মাইলসে আমাদের কাজ করাটা অলমোস্ট এক হিসেবেই ছিল। সবার ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় কিন্তু যখন কাজ করেছি, তখন সবাই এক। এমনটি ছিল বলেই, আমরা ব্যান্ড হিসেবে এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি।
আপনাদের দুই ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্কটা কেমন ছিল?
হামিন আহমেদ : প্রথমে তো অবশ্যই ভাই। মাইলস ব্যান্ডে সে আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিল। আসা-যাওয়া বলতে, কখনো দেশের বাইরে ছিল। আবার যোগ দিয়েছে। ও একটু চাপা প্রকৃতির কিন্তু অনুভূতি প্রকাশ একরকমই। ওর জিদ আছে, আমারও জিদ আছে। তবে আমরা দুজনে খুবই একরকম।
ব্যান্ডের ভোকাল হিসেবে শাফিন আহমেদ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, এটা নিয়ে আপনার কেমন গর্ব হতো?
হামিন আহমেদ : ভোকালিস্ট হিসেবে এখানে একটা কথা বলতে চাই, মানুষের কাছে ওর যে গ্রহণযোগ্যতা, যেভাবে মানুষ তাঁকে গ্রহণ করছে—সেটাই হচ্ছে শাফিনের সাফল্য ও যোগ্যতার আসল মাপকাঠি। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক যাত্রায় যখন বিভিন্ন ব্যান্ড বিভিন্ন কাজ করছে এবং মাইলস যখন ‘প্রতিশ্রুতি’ অ্যালবাম প্রকাশ করল, গানগুলোর সৃষ্টি যে রকম সুন্দর ছিল, একইভাবে তখনকার ব্যান্ড মিউজিকে গায়কির ক্ষেত্রে যে জায়গাটা ছিল, অন্যরা যে জায়গায় ছিল, শাফিন সেখানে একটা অন্য একটা মাত্রা এনে দিয়েছিল। ‘প্রতিশ্রুতি’ তো তখন দাবানলের মতো জ্বলে উঠল। কেন? গানের কম্পোজিশন তো বটেই, শাফিনের কণ্ঠটাও একটা ব্যাপার ছিল।
আমারও কিছু গান ছিল, কিন্তু ওর গলায় যেভাবে ‘চাঁদ তারা সূর্য’, ‘ধিকি ধিকি’, ‘ফিরিয়ে দাও’, ‘জাদু’, ‘পাহাড়ি মেয়ে’—অন্য মাত্রায় পৌঁছেছে, তা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। কাউকে ছোট করছি না, বাস্তবতা থেকে বলছি—এখনকার কেউ যদি সেই ১৯৯১ সালের ‘প্রতিশ্রুতি’ রিলিজের সময় আরও যত গান রিলিজ হয়েছিল, সব একবার শোনে। এরপর ‘প্রতিশ্রুতি’ শোনে, তাহলে সে পার্থক্যটা বুঝতে পারবে। পার্টিকুলারলি শাফিনের কথায় আসি, গান গাওয়ার ক্ষেত্রে ওর যে গায়কি, ডেলিভারি ও গলার টোন—তা মানুষকে একদম পাগল করে দিয়েছিল। ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘প্রত্যাশা’, ‘প্রত্যয়’ অ্যালবামের সময়টা যারা দেখেছে শুধু তারাই এটা বুঝবে। এখন যদি বলতে হয়, দেখা গেছে, স্টুডিওতে আজকে ও কণ্ঠ দিচ্ছে, কালকে আমি দিচ্ছি। এরপর প্যানেলে এসে যখন শাফিনের গানটা শুনতাম, বুঝতাম যে ওর গায়কি কত সুন্দর। কত মাপা। কোন জায়গাটা ছাড়তে হবে, কোন জায়গাটা ধরতে হবে। গান গাওয়াটা শুধু তো সুর আর ছন্দ নয়—এটা মানুষ অনেক সময় বোঝেও না, এর বাইরেও অনেক ব্যাপার আছে। এই ব্যাপার ওর মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রেই ছিল।
কতটুকু ছাড়তে হবে, কতটুকু ধরতে হবে, কোন জায়গায় কোন অভিব্যক্তি দিতে হবে—এগুলোর একটা চমৎকার কম্বিনেশন হচ্ছে শাফিনের কণ্ঠ এবং গায়কি। আমি বলতামও, খুব ভালো গাইছিস। অবশ্যই গর্বিত হতাম, অনেক বেশি। প্রত্যেক মেম্বারই গর্বিত ছিলাম। ছিলাম বলেই মাইলসে ওর আসা-যাওয়া এভাবে ছিল, যখন লন্ডন চলে গেল, আবার ফিরে এল, আমাদের মনে হয়নি, সে ফিরে আসছে। আমরা ভাবতাম, সে তো আসলে মাইলসে ছিল, মাইলসে আছে—সে তো বাইরের কেউ না। আমাদের সবার আরেকটা বিশেষত্ব ছিল যে সবার সংগীতের যাত্রা এবং পরিচয় প্রধানত মাইলস। আমরা তরুণ বয়স থেকেই যেহেতু মাইলসের সঙ্গে। সুতরাং আমাদের পুরো মিউজিক্যাল গ্রোথ হয়েছে মাইলস থেকেই। এ জন্য অনেককে বলে না, মাইলস হচ্ছে পরিপূর্ণ একটা ব্যান্ড। এটা বলার অনেকগুলো কারণের মধ্যে এটা একটা।
কণ্ঠের কারণে শাফিন আহমেদের যে জনপ্রিয়তা এ নিয়ে কি কখনো ঈর্ষা হতো?
হামিন আহমেদ : কখনোই এমনটি হয়নি। আমার নীতি ও অবস্থান বরাবরই কঠিন, সেটা থেকে আমি নড়ি না। কিন্তু আমি জানি যে কোনটা কী, কোনটা ঠিক নয়। এটাও ঠিক, সবকিছু যে জানি তা–ও তো না। তবে সাধারণত এ পর্যন্ত যেটাকে ভুল ভেবেছিলাম, সেটা আসলেই ভুল ছিল। যেটাকে ঠিক ভেবেছিলাম, সেটা আসলেই ঠিক। বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতায় আমি এটা বলব যে কখনো মনের মধ্যে ঈর্ষা আসেনি। আমি এবং আমরা ব্যান্ডের সবাই শাফিনের সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় খুব হ্যাপি ছিলাম।
হঠাৎ পাওয়া শাফিন আহমেদের মৃত্যু সংবাদ বড় ভাই হিসেবে আপনার জন্য কতটা কষ্টদায়ক ছিল?
হামিন আহমেদ : এটা আসলে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যেটুকু বলতে পারি, শাফিনের মৃত্যুর খবরে আমার কলিজা ছিঁড়ে গেছে মনে হয়েছে। ভার্জিনিয়াতে আমার বন্ধুদের ফোনে বলছি, ওকে ফ্রিজার করে রাখতে! কিছুই ভাবতে পারছি না। কীভাবে কী হয়ে গেল!