২০০২ সালে নেওয়া সুবীর নন্দীর সাক্ষাৎকার

'সাধনা এবং সংগীত মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ'

সুবীর নন্দী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
সুবীর নন্দী। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

২০০২ সালের ৭ মে। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। সুবীর নন্দীর সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর ওই সময়ের কর্মস্থল মতিঝিলের জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের একটি কক্ষে। সেদিন কাজের ফাঁকে অল্প সময় কথা হয়। বলেছিলেন বাসায় যেতে। শুক্রবার তিনি সময় দেন তাঁর গ্রিন রোডের বাসায়।

বিস্কুট, চানাচুর খেতে খেতে সেদিন অনেক কথাই হয়েছিল। গান নিয়ে, ওই সময়ের গানের বাজার নিয়ে। তরুণ প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে। মনে হয়েছিল, তিনি বেশ আশাবাদী মানুষ। নবীনদের উৎসাহ দিতেন নানাভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই সময়েও ভালো গান হচ্ছে, গান স্থায়ী হবে। ব্যান্ড আর পপ সংগীত নিয়েও তাঁর ছিল ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর সঙ্গে দুই দিনের আলাপচারিতার কিছু অংশ ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোর ‘আনন্দ’ পাতায়, ২৩ মে। সেই সাক্ষাৎকার সূত্রে আরেকবার জেনে নিই আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দীকে।

গত শতকের ষাট দশককে বলা হয় আধুনিক বাংলা গানের জাগরণের সময়। এরপর দ্রুত এর সংস্কার হলেও এই একুশ শতকে এসে বাংলা আধুনিক গান তার কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে আসতে পেরেছে?
নিশ্চয়ই আসতে পেরেছে। বিন্দুমাত্র সন্দেহ এতে নেই। ষাট দশক ছিল আধুনিক বাংলা গানের উত্তরণের সময়। ওই সময় আমাদের দেশে ছিল ভারতীয় বাংলা গানের একচ্ছত্র প্রভাব। আর এই প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী তাঁদের সংগীত প্রতিভা, জ্ঞান এবং ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছিলেন আধুনিক বাংলা গানের নতুন অধ্যায়। এ প্রসঙ্গে বলতে গেলে সবার আগে যাঁর নামটি আসে, তিনি আবু বক্কর সিদ্দিকী। আরও ছিলেন শ্রদ্ধেয় আব্দুল আলিম চৌধুরী, আব্দুল আহাদ চৌধুরী, কামাল হোসেন, আলাউদ্দিন প্রমুখ। তাঁরা আমাদের নিজস্ব গীতিকার, সুরকার নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে গান করে আধুনিক বাংলা গানকে একটা প্ল্যাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দেন। স্বাধীনতার পর তৈরি হলো আরেকটা ধারা। তখন গানের মধ্যে ফোক গানের প্রভাব পড়ে। ওই সময় এর কান্ডারি ছিলেন আজম খান, ফিরোজ সাঁই প্রমুখ।

আপনার অনেক বড় সংগীতজীবন। এই জীবনে কোন শিল্পীর গান আপনাকে বেশি প্রভাবিত করেছে?
নিজের অজান্তে ছোটবেলা থেকে গান শুনতে শুনতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগজিৎ সিংয়ের ভক্তে পরিণত হয়েছিলাম। তাঁদের গান এখনো আমি শুনি, যা তখন আমাকে প্রভাবিত করেছে।

আজকের সুবীর নন্দী হয়ে ওঠার পেছনে বড় অবদান কার?
এটা আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কেননা আমার সংগীতজীবনে অনেকের অবদান আছে, একজনকে আলাদা করে বলা কঠিন। কারণ, আমি অনেকের কাছে গানের তালিম নিয়েছি। ওস্তাদ ছিলেন। স্কুলে গান করতে কেউ কেউ শিখিয়েছেন।

৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে যাঁদের বয়স, তাঁদের একটা বড় অংশ কিন্তু এখন গান শুনছেন না। এখন গান শুনছে তরুণ প্রজন্ম। তাঁদের বয়স¦১৪ থেকে ২২-এর মধ্যে। এর কারণ কী?
আসলে সংগীত ব্যাপারটা সময়নির্ভর। একটা নির্দিষ্ট ধারার ওপর ভর করে এর চলন, বলন, আকারের পরিবর্তন ঘটে। আগে ভালো যা ছিল, এখনো আছে। এখনো তৈরি হচ্ছে শ্রুতিমধুর গান। তবে এখন মানুষের সময় খুব সীমিত হয়ে গেছে। মানুষ এখন দুপুরে ভাতের ঝামেলা এড়ানোর জন্য একটি বার্গার খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এই ‘বার্গার’ সংস্কৃতির সময় অনেকে হয়তো বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার সময় গাড়িতে গান শোনা ছাড়া অন্য কোনো সময় বের করতে পারে না। আবার জ্ঞানী শ্রোতার মধ্যে একটা দর্শন কাজ করে।¦তাঁরা মনে করেন, ভারতীয় গান না শুনলে জ্ঞানী শ্রোতা হওয়া যাবে না।

কিন্তু তাঁরা বলছেন, এখন আগের মতো ভালো গান তৈরি হচ্ছে না। আগের সেই সোনালি অধ্যায় নেই।
এটা ঠিক নয়। এ ধরনের শ্রোতাদের যদি প্রশ্ন করেন, এই সময়ের কয়টা গান শুনেছেন? উত্তরে তাঁরা বলবেন, ঠিক অমন করে শোনা হচ্ছে না। গান না শুনেই তাঁরা এ ধরনের মন্তব্য করেন। নেতিবাচক মন্তব্য করা তাঁদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি তো আগেই বলেছি, সংগীত পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে এর চলন-বলনের পরিবর্তন হবেই। যেমন সময়ের সঙ্গে পোশাক-আশাকে পরিবর্তন; চলাফেরা, রীতিনীতিতে পরিবর্তন; আচার-অনুষ্ঠানে বিশাল পরিবর্তন হচ্ছে। আমার কথাই বলি, আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমার যেসব গান ভালো লাগত, এখন সেগুলো আর ভালো লাগে না। বরং সেগুলো শুনলে বিরক্ত হই। এখন আমার তৈরি হয়েছে ভিন্ন চাহিদা, এটাই স্বাভাবিক। কাজেই একটা জিনিস আঁকড়ে বসে থাকলে হবে না। 

তাহলে আপনি বলতে চান এখনো আধুনিক বাংলা গানে আগের সেই অভিজাত রূপ বিদ্যমান?
অবশ্যই। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনসহ নানা পরিবর্তনের মধ্যেও এর গ্রহণযোগ্যতা এখনো আছে। আমার মনে হয়, এর রূপ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। এই সময়ে অনেকে ভালো গান করছে—রফিকুল আলম, এন্ড্রু কিশোর, তপন চৌধুরী, কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, মনির খান। এঁদের বিশাল শ্রোতাগোষ্ঠী আছে। তাঁদের অ্যালবামের পেছনে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হচ্ছে। তবে এখন চিন্তার বিষয় হলো আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে কি না। যাঁরা এখন কাজ করছেন, তাঁদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গানের মূলধারা বদলে না যায়। 

আগে দেখা গেছে, প্রত্যেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী কোনো না কোনো ওস্তাদের কাছে গান শিখে এসেছেন। কিন্তু এখন অনেক নতুন শিল্পী। তাদের কাছে জানতে চাইলে হয়তো বলবে, আমি শুনতে শুনতে গায়ক।
একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গান শেখা এক জিনিস আর গাওয়া আরেক জিনিস। গান শিখলেই যে ভালো শিল্পী হওয়া যাবে, ভালো গান গাওয়া যাবে, এটা ঠিক নয়। দেখা যায়, অনেকে ২০–২৫টি রাগ জানে,কিন্তু গাইতে দিলে আধা ঘণ্টা গাইতে পারবে না। অন্যদিকে একটা ছেলে দুটি রাগ জানে, সে ওই দুটি ব্যবহার করে সুন্দর একটি ঠুমরি গেয়ে দিল, কিংবা আধুনিক একটি গান সুন্দর করে গেয়ে দিল।

এ ক্ষেত্রে প্রতিভা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
হ্যাঁ, আসলে সংগীত ঐশ্বরিক বিষয়। ঈশ্বরের সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কথা হলো, ‘অনুশীলন’।অনুশীলনের বিকল্প নেই। সাধনা ছাড়া ‘সংগীত’ কল্পনামাত্র। সাধনা ও সংগীত মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হয়তো প্রতিভার গুণে হয়ে উঠল শিল্পী, কিন্তু এটা খুব সীমিত সময়ের জন্য। এভাবে হয়তো বড়জোর এক থেকে দুই বছর চালানো যাবে। এরপর হারিয়ে যেতে হবে। অন্য কোনো উপায় নেই। 

এখন অনেকেই পপ ও ব্যান্ড সংগীতকে অপসংস্কৃতির ফসল বলেন। তাঁরা বলেন, এটা আমাদের বাংলা গানের জন্য হুমকিস্বরূপ। আপনি কী মনে করেন?
আমি বিশ্বাস করি, সংগীত সবটাই সংগীত। সংগীতে ‘অপ’ বলতে কিছু নেই। আমাদের দেশে অনেক পণ্ডিতশ্রেণির সমালোচক পপ সংগীত কিংবা ব্যান্ড সংগীতকে নাক সিটকান। এটা আমাকে খুব ব্যথিত করে। একটা জিনিসকে আমি জানলাম না ভালো করে, বলে ফেললাম জাত গেল, জাত গেল। এটা ঠিক নয়। কারণ, আমাদের পপ ও ব্যান্ডের আন্দোলন অনেক এগিয়ে গেছে। ওরা আলাদা ডাইমেনশন গড়ে তুলে একটা বিশাল শ্রোতাশ্রেণি তৈরি করেছে। আমি মনে করি, আমাদের সংগীতের জন্য ভারতীয় গান হুমকিস্বরূপ। এর জোয়ারেই আমাদের গানের ভেসে যাওয়ার উপক্রম। হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাজারে যেভাবে হিন্দি সংগীতের চর্চা হচ্ছে, তাতে আমাদের দেশীয় গানের জন্য এটা এক অশনিসংকেত। 

শুধু সংগীতকে পেশা করে জীবন ধারণ করা আমাদের দেশে সম্ভব?
হ্যাঁ। আমি মনে করি, সেই পরিবেশ এক শ ভাগ তৈরি হয়েছে। আমাদের দেশে এখন যাঁরা গাইছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগে কাজ করছেন, তাঁরা তো এটা নিয়েই আছেন। যন্ত্র প্রকৌশলী থেকে শুরু করে পরিচালক, সুরকার, গীতিকার—সবাই তো ভালোই আছেন।

কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, আমাদের দেশের শিল্পীরা শেষজীবনে অর্থকষ্টে ভোগেন।
এটা আমাদের নিজেদেরই সৃষ্ট সমস্যা। অন্য পেশার ক্ষেত্রে খেয়াল করেন, অন্য পেশার লোক নানা উপায়ে তাদের কাজের যোগ্য পারিশ্রমিক আদায় করে নেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজের অধিকার আদায়ে তারা সংগঠিত। আমরা শিল্পীরা নিজেদের পাওনা আদায়ে মনোযোগী নই, সংগঠিত নই। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। শিল্পীদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজেদেরও ভাবতে হবে। পাশাপাশি দেশেরও শিল্পীদের প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়ে যায়।