>বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক অনন্য নাম তারেক মাসুদ। আজ তাঁর জন্মদিন। অকালপ্রয়াত নন্দিত এই চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্মদিনের প্রাক্কালে তাঁর চলচ্চিত্র নির্মাতা স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের মুখোমুখি হয়েছিল প্রথম আলো
আপনাদের দেখা হয়েছিল কীভাবে?
সাহিত্যিক আহমদ ছফার মাধ্যমে। কলকাতায় এক বন্ধু মারফত তাঁর (ছফা) সঙ্গে পরিচয়। ছফা ভাই তখন বলেছিলেন, ঢাকায় এলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। ১৯৮৭ সালে আমি যখন বাংলাদেশে আসি, ছফা ভাই তখন ইন্দিরা রোডে থাকতেন। ওনার নিজের বাসা ছিল গুলশানে, তবু তিনি থাকতেন ড. মফিজ চৌধুরীর এই জীর্ণশীর্ণ বাড়িটিতে। নির্মলেন্দু গুণ থেকে এস এম সুলতান, সেই সময়ের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা অনেকেই আসতেন সেখানে। বাসাটার নাম সবাই দিয়েছিল ‘পাগলা ঘর’। সুলতানের আঁকা ছবি আমাকে মুগ্ধ করত, আর তাই ছফা ভাই ডাকলেই আমি চলে যেতাম।
জুলাইয়ের এক বিকেলে তারেক (মাসুদ) আমাকে ফোন করে বলল, ‘ছফা ভাই বলেছেন আপনাকে ফোন করে আসতে বলতে।’ আমি ভাবলাম, ‘এই লোক আমাকে ফোন দিচ্ছে কেন?’ তারেক তখন আদম সুরত নিয়ে কাজ শুরু করেছে, তবে খুব বেশি দূর এগোয়নি কাজ। পাগলা ঘরে সে-ও তখন থাকত ছফা ভাইয়ের সঙ্গে। ছফা ভাই ছিলেন তারেকের ‘গুরু’। ছফা ভাই তাকে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা থেকে একটা মেয়ে আসছে, দেখো, সে হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারে।’
তারেক মাসুদের সঙ্গে পুরো জীবন কাটানোর কথা কখন ভাবলেন?
ছফা ভাইয়ের এখানে বিশেষ ভূমিকা আছে। তিনি আমাদের একসঙ্গে কল্পনা করতেন। কখনো আমাকে বলতেন, ‘তারেক তো তোমার প্রেমে পড়েছে’ আর তারেককে বলতেন, ‘ক্যাথরিন তো তোমার প্রেমে পড়েছে।’
সময়টা ১৯৮৮, এরশাদের শাসনামলের প্রায় শেষের দিকে। টানা হরতাল থাকত আর আমাদের তেমন কিছু করারও ছিল না। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতো, কিন্তু আমাদের আড্ডা শেষ হতো না। আস্তে আস্তে আমি আর তারেক বন্ধু, এমনকি বন্ধু থেকেও বেশি কিছু হয়ে উঠলাম।
আপনি তো ছবি আঁকতেন। তারেক মাসুদ কি আপনার শিল্পীসত্তার ভক্ত ছিলেন?
ও চাইত আমি ছবি আঁকি, কিন্তু সিনেমাকে জীবন আর জীবিকা হিসেবে নেওয়ার পর সেভাবে তুলি হাতে নেওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে যেই সাড়ে চার বছর আমরা নিউইয়র্কে ছিলাম, তখন ছবি এঁকেছি। এমনও হয়েছে, মুক্তির গান নিয়ে কাজ করার সময় সব টাকা ওখানেই যাচ্ছে, বাসা ভাড়ার জন্য আলাদা করে টাকা রাখা হয়নি। আমাদের বাড়িওয়ালা ছিলেন দার্শনিক, একটা বই লিখছিলেন তিনি। তাঁকে তখন আমরা আমার আঁকা ছবি দিয়ে দিতাম।
মানুষ হিসেবে তারেক মাসুদ কেমন ছিলেন?
তারেক আমার দেখা সবচেয়ে ‘আন-সেক্সিস্ট’ মানুষ। কেউ যখন বলত, ‘তারেক মাসুদের সিনেমা’, তখন ও খুব রেগে যেত। বলত, ‘ওরা কেন ক্যাথরিনের কথা বলে না? এটা তো তারও সিনেমা।’ ঘর গোছাতে খুব পছন্দ করত তারেক। কখনো কখনো আমাকে বলত, তুমি বাইরে থেকে দুপুরে খেয়ে আসো। তিন-চার ঘণ্টা পর আমি ফিরে দেখতাম ফার্নিচার আর আসবাব এদিক-ওদিক করে ও বাসার চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে। ও কখনো চায়নি আমি গৃহিণী হই। তারেক সব সময় আমাকে একজন পার্টনার হিসেবে যোগ্য সম্মান দিয়েছে। আমাদের মধ্যে মতের অমিল হলেও সেটা সিনেমা নিয়ে হতো। তার নিজের সময় থেকে তারেক ছিল অনেক এগিয়ে। সিনেমায় প্রযুক্তি ব্যবহারের বেলায়ও সে ছিল দূরদর্শী। অন্তর্যাত্রা দেশের প্রথম ডিজিটাল ফিচার ফিল্ম। কিন্তু সিনেমা হলগুলো তখন অভ্যস্থ ছিল বেটা ফরম্যাটে, কোনো সিনেমা হল নিতে চায়নি সেই ছবি। আমাদের অগ্রিম টাকা দিয়ে তাদের মানাতে হয়েছে। আর এখন তো সব ডিজিটাল ফরম্যাটেই হচ্ছে।
তারেক মাসুদকে নিয়ে কোন কাজ করছেন এখন?
একটা বইয়ের কাজ প্রায় শেষ। আগামী বইমেলায় কথা প্রকাশনী থেকে বের হবে সিনেমা কথা। এটা তারেকের সাক্ষাৎকার আর বক্তৃতার একটা সংকলন। তারেক লিখত কম, কিন্তু বক্তা হিসেবে ছিল দুর্দান্ত।
সাক্ষাৎকার: কামরুল হাসান