নয়ন মনি, সারেং বৌ, গোলাপী এখন ট্রেনেসহ দুই শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত অভিনেতা ফারুক। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয়জীবন থেকে অনেক কিছু পেলেও এখন আর অভিনয় করার ইচ্ছে তাঁর নেই। নিজের ব্যবসা নিয়েই থাকতে চান তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই রাজনীতির সঙ্গে জড়ান তিনি। অনেক স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর তাঁর উপলব্ধি, যে স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, সেই স্বপ্নের কাছাকাছিও পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিজয় দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চট্টগ্রামে আছেন ফারুক। প্রথম আলোর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন গুণী এ অভিনেতা। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের ।
যে স্বপ্ন নিয়ে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, স্বাধীনতার ৪৩ বছরে সেই স্বপ্নের কতটা কাছাকাছি যেতে পেরেছেন বলে মনে হয়?
এটা তো একটা সময়ের ব্যাপার। সময়ের ব্যাপার বলতে আমি বুঝি, যাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে গেলাম, দেশ স্বাধীন হলো, তিনি একটা যুদ্ধকে, দেশকে এবং দেশের যোদ্ধা ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যতটা অনুভব করবেন, তা অন্য কারও পক্ষে অনুভব করা সম্ভব নয়। সে কারণে আমি বলতে পারি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর থেকে দেশের পাওয়া না-পাওয়া বা মুক্তিযোদ্ধাদের চাওয়া, সবকিছুই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে অন্তর ভরে শ্বাস নিয়েছিলাম, তাতে আজকে কেমন যেন পচন ধরে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই স্বপ্নের কাছাকাছি আমরা কোনোভাবেই যেতে পারিনি।
স্বপ্ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে সময় লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধা বা মানুষ, যাঁরা জীবন হারিয়েছেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, যে কারণে আমার মা-বোনেরা ইজ্জত হারিয়েছেন, তা তো আমরা সবাই কম–বেশি জানি। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিষয়টা ছিল স্বাধীনতা, ছিল মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার। ক্ষুধামুক্ত সমাজ–ব্যবস্থা গঠন। আরও ছিল সবার জন্য শিক্ষা, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। গণতন্ত্র বলতে আমি যেটা বুঝি, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ এক দেশে বাস করবে, সবারই সমান অধিকার থাকবে। মানে ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র হবে। মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম তো এসব নিশ্চিত করার জন্যই। কিন্তু নির্মম পরিহাস। এখন তো মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচয়ই দিতে ইচ্ছে করে না।
মুক্তিযোদ্ধা বলে কেন পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না?
স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্মান নেই। মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করেন, রিকশা চালান, দিনমজুরের কাজ করেন। বীরাঙ্গনা যাঁরা, তাঁরা তো আমারই মা, আমারই বোন, আমাদেরই কারও স্ত্রী। অথচ তাঁদের দেখে এখনকার প্রজন্ম টিটকারি করে। নতুন প্রজন্মকে আমরা এখনো মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাস বলতে পারলাম না। এখনো আমরা চেয়ার দখল নিয়েই ব্যস্ত। আমার কথা হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দিতে হবে। যাঁরা জীবন দিয়েছেন এবং যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা নিয়ে অনেক জায়গায় মশকরা করতেও শুনেছি। আমি নিজে অনেক জায়গায় এ–ও শুনেছি, ‘আরে, আপনি মুক্তিযোদ্ধা নাকি! আপনি যুদ্ধ করেছেন!’ এটা কী ধরনের আচরণ? এসব বিষয় নিয়ে আমার ভেতর অনেক ক্ষোভ আছে। আমি ভাই স্বাধীনচেতা মানুষ, আমার ক্ষোভ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আপনি যুক্ত ছিলেন। এ জন্য আপনাকে মামলার মুখেও পড়তে হয়েছিল...
ছয় দফা আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার নামে ৩৭টি মামলা ছিল। বেশির ভাগই ছিল হয়রানিমূলক, আর অন্যগুলো রাজনৈতিক।
স্বাধীনতা অর্জনের পরপর এবং বর্তমান সময়ে বিজয় দিবস উদযাপনের মধ্যে কতটুকু তফাত আপনি দেখতে পান?
তখন বিজয় দিবস ছিল না, ছিল বিজয়ের আনন্দ। বিজয়ের আনন্দ যে কী, তা কোনোভাবেই বলে বোঝানো যাবে না। ওই সময় বিজয় দিবসে যে উল্লাস হতো, তা এখন আর নেই। এখন শুধু সভা-সেমিনার আর কথায় সীমাবদ্ধ বিজয় দিবস।
বর্তমান প্রজন্মকে আপনার কিছু বলার আছে?
যুদ্ধ তো শেষ হয়েছে। খান আতার (খান আতাউর রহমান) ছবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে যদি বলি, ‘এখনো অনেক রাত’ কথাটা সঠিক হবে, বেঠিক হবে না। আমার মতে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু পুরোপুরি স্বাধীনতা এখনো পাইনি। এর পেছনে রয়েছে অনেক অনেক ঘটনা। আমাকে যে ইচ্ছে মেরে ফেলতে পারে, এটা নিয়ে কিন্তু মোটেও বিচলিত নই। মানুষের জন্মই হয়েছে মৃত্যুর জন্য। যুদ্ধাপরাধীর বিচারগুলো এখনো পূর্ণতা পায়নি। আমরা যদি পৃথিবী থেকে চলেও যাই, তোমরা কিন্তু ভুলো না। নতুন প্রজন্মকে বলব, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস জানার চেষ্টা করো। কী কষ্ট করে কত নদী রক্ত দিয়ে এই দেশ স্বাধীন করা হয়েছে, এই কথাটা মাথায় রেখে দেশের জন্য কাজ করো। দেশের মাটিকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসো। সৎ এবং সুন্দরভাবে বাঁচার চেষ্টা করো। তাহলে দেখবে চলার পথে কোনো ধরনের বাধাকে বাধা মনে হবে না। নানাভাবে স্বাধীনতার দলিল তৈরি করতে হবে এবং সেই দলিল ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। রাজনৈতিক কারণে যদি বিভিন্ন দল বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করে, তা দুঃখজনক। স্বাধীনতাকামী একজন মানুষ হিসেবে দল কোনোদিন আমার কাছে মুখ্য না।
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
এটা ঠিক যে আমি একসময় ওতপ্রোতভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। এখন তো আমি নায়ক ফারুক। সবার কাছে ফারুক ভাই। রাজনীতিতে এখন যা হচ্ছে তা হলো, ‘তোকে পারলে আমি মারব, আমাকে পারলে তুই মার।’ এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি মোটেও ঠিক না। এটা কিন্তু রাজনীতির ভাষা না। রাজনীতির ভাষা হলো, একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দুই দলের, দুই মতের নেতা কথা বলবেন। এই দেশে পঁচাত্তর ঘটানো হবে, একুশে আগস্ট ঘটানো হবে, আহসানউল্লাহ মাস্টারের মতো নেতাকে মেরে ফেলা হবে, এসব তো আমরা চাইনি কোনো দিন। রাজনীতিতে আমরা চাই একই মঞ্চে কথা বলব, ভাইয়ে ভাইয়ে যুক্তিতর্ক করব। ভেতরে হয়তো জয়ী হওয়ার একটা প্রতিযোগিতা থাকবে। তবে সেই জয়টা হচ্ছে, মানুষকে ভালোবাসার। মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পারাটাই একজন রাজনৈতিক নেতার সবচেয়ে বড় সার্থকতা। রাজনীতি মানে কিন্তু খুন না। জোর করে জমি দখল করা না। এখনকার রাজনৈতিক যে সংস্কৃতি, তা আমার মোটেও পছন্দ না। ধ্বংসাত্মক কোনো কিছুই কাম্য নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আমার যেটা মনে হয়, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এখন যে বিচার হচ্ছে, তার এতটা দীর্ঘসূত্রতা আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। যা–ই করেন, যেটাই করেন, তাড়াতাড়ি শেষ করেন।
ভবিষ্যতে কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান আপনি?
আমি প্রায়ই একটা কথা বলি, দেশকে ভালোবাসুন, দেশের মাটিকে ভালোবাসুন। এটা বলতেই থাকব। জানি না, আমার জীবনে কোনো দিন দেখতে পাব কি না, তরুণ প্রজন্ম মাটিকে বুকে নিয়ে নিয়েছে। এমনটা হলে তা পৃথিবীর কাছে বড় একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আজকে দেশটা অনেক সুন্দর অবস্থানে আছে। সুন্দরভাবে আছে। আমি চাই, এই ধারা অব্যাহত থাকুক।
অনেক দিন ধরে আপনাকে চলচ্চিত্রে পাওয়াই যাচ্ছে না। এর কারণ কী?
আমাকে তো চলচ্চিত্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। চলচ্চিত্রে থাকতে না পেরে বেরিয়ে গেলাম মানে তো বের করে দেওয়াই হলো। ওই ধরনের গল্প পাই না, ওই ধরনের পরিচালকও নেই। যে কারণে কাজ করতে আগ্রহ পাই না। কিছুদিন আগেও মুক্তিযুদ্ধের গল্পের একটি ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু সেটির গল্পও পছন্দ হয়নি। আমার আর ছবিতে ফেরার ইচ্ছেও নেই। আমি এখন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছি। এখন এটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।
দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসংখ্য ছবি নির্মিত হয়েছে। এসব ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে কি?
আমার মনে হয় আজও মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চিত্র কোনো ছবিতে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের ওপর অনেক ছবি নির্মিত হতে পারে। এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ছবি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে যে পরিমাণ আয়োজন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মিত হওয়া দরকার, তার কোনোটিই আমাদের নেই।