সালমান শাহ রাত ১২টায় খদ্দরের পাঞ্জাবি ও লেদারের ব্যাগ পাঠিয়ে দিত: মতিন রহমান

‘রাঙ্গা ভাবী’, ‘অন্ধবিশ্বাস’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘রং নাম্বার’সহ একাধিক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন পরিচালক মতিন রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে অনেকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। কথা হয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই নির্মাতার সঙ্গে
একাধিক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন পরিচালক মতিন রহমান
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন

শুভ জন্মদিন...

ধন্যবাদ। আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বিনীতভাবে শুধরে দিচ্ছি, আজ আমার জন্মদিন নয়। গত ১৮ মার্চ ছিল আমার জন্মদিন। সার্টিফিকেটে বয়স বাড়ানোর জন্য স্কুল থেকে বয়স বাড়ানো হয়েছিল।

প্রশ্ন

আপনি দেশের জনপ্রিয় সব তারকাকে নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন, তাঁরা কি এমন ভুল করেছেন?

আমার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে সালমান শাহ, শাবনূর, ফেরদৌসসহ অনেকেই আমার জন্মদিন জানতেন। তাঁরা কখনো ভুল করতেন না। অনেকে ১৮ মার্চ উপহার নিয়ে বাসায় আসতেন। এখনো কেউ কেউ বাসায় কেক পাঠিয়ে দেন। এখনো মনে আছে, সালমান রাত ১২টায় খদ্দরের পাঞ্জাবি ও লেদারের ব্যাগ পাঠিয়ে দিত। এমন অনেক ঘটনাই ছিল।

প্রশ্ন

‘রাঙ্গা ভাবী’, ‘অন্ধবিশ্বাস’, ‘তোমাকে চাই’, ‘বিয়ের ফুল’, ‘রং নাম্বার’সহ একাধিক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়ে হঠাৎ এক যুগ আগে সিনেমা থেকে সরে গেলেন কেন?

তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। পরে অনেক চাপ পড়ে গেল। মনটাকে ফ্রি করতে পারলাম না। একসঙ্গে অন্য পেশায় দুটি কাজ করা যায়, কিন্তু সিনেমায় তা হয় না। সিনেমা বানাতে গেলে ২৪ ঘণ্টা একটা কাজের মধ্যেই থাকতে হয়। পরে নিয়মিত শিক্ষকতা শুরু করলাম। নতুন প্রজন্মের নির্মাতাদের হাতে-কলমে পড়াতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম, আমার ছাত্র যারা তৈরি হবে, তারা আমার চেয়েও ভালো ছবি বানাবে। এটা ছিল আমার গোপন ইচ্ছা। এখনো তাদের নিয়েই আছি।

পরিচালক মতিন রহমান
প্রশ্ন

’৮২ সালে প্রথম নির্মাণ করলেন ‘লাল কাজল’ সিনেমা। সে হিসাবে আপনার ক্যারিয়ার চার দশকের। দীর্ঘ এই সময়ে নির্মাতা হিসেবে পথটা কেমন ছিল?

এটা ছিল একধরনের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম মন-মনন-চেতনা থেকে এলে কোনো বাধা-অপমান নিয়ে চলাকেও কষ্টের মনে হয় না। এখানে কত ছবি ফ্লপ করছে, কত প্রযোজকের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে। অনেকেই কাজ করিয়ে নিয়ে টাকা দেননি, এগুলো নিয়েই সবাই একসঙ্গে চলেছি। এখন অনেকেই মনে রাখেন, সিনেমা নিয়ে কথা বলেন, ভালো লাগে। মেরিল-প্রথম আলো প্রোগ্রামে রিয়াজ-ফেরদৌসকে দেখলাম উপস্থাপক হিসেবে। খুবই ভালো লাগল। তাদের সঙ্গে অনেক বিষয় নিয়ে কথা হলো, মনে হলো আপন মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, আমি একা নই। সিনেমার জন্যই এখনো ভালোবাসাটা পাই।

প্রশ্ন

আপনার প্রথম সিনেমা ‘লাল কাজল’-এর চিত্রনাট্যকার ছিলেন এ টি এম শামসুজ্জামান, তিনি তখন তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা, আপনার মতো তরুণের ওপর আস্থা রেখেছিলেন কীভাবে?

এটা অনেক মজার ঘটনা। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর মনে হলো, এখন সিনেমা বানানো যায়। সেই সময়ে ‘প্রেম তুই সর্বনাশী’ নামের একটি উপন্যাস হাতে আসে। এটা আমার পছন্দ হয়ে যায়। আমি প্রযোজক ঠিক করলাম। তখন নির্মাতা হওয়া কঠিন ছিল। প্রযোজক আমার খোঁজখবর নিয়ে বললেন, আমি যে পরিচালকের সঙ্গে কাজ করি, তাঁর সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। আমি খুশিমনে আজিজুর রহমান ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি এডিটিং প্যানেলে ছিলেন। তিনি বের হয়ে এলেন। আমি বললাম, ‘তিনি আমাকে দিয়ে একটা ছবি বানাতে চাইছেন, আপনার সঙ্গে একটু কথা বলবেন।’ আজিজুর রহমান রেগে চিৎকার করে বললেন, ‘স্টুপিড, ইডিয়ট, তুমি কী ছবি বানাবে? তুমি কাজ জানো না।’ আজিজুর ভাই প্রযোজকদের বললেন, ‘ওকে দিয়ে কোনো সিনেমা বানাবেন না। কাজ শিখে নাই।’ আমি তো একদম বোকা হয়ে গেলাম।

‘তোমাকে চাই’ সিনেমার পোস্টার
প্রশ্ন

তখন প্রযোজক কী বললেন?

প্রযোজকের সামনে আমি একদম বোকা হয়ে গেলাম। প্রযোজক বললেন, ‘আপনার গুরু বলছেন আপনি কোনো কাজ জানেন না। আপনার ওপর আমার ভরসা নেই।’ কাজ হলো না। এর ঠিক পরেই আজিজুর রহমান ভাই আমাকে এ টি এম শামসুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, ‘প্রতিদিন তুমি এ টি এম ভাইয়ের বাসায় যাবা আর পরের দিন তাঁকে নিয়ে শুটিংয়ে আসবা।’ আমাদের তিন সিনেমার প্রধান চরিত্র ছিলেন এ টি এম শামসুজ্জামান। এর মধ্যে এ টি এম ভাই আজিজুর রহমানের আরেকটি সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করছেন। সেই সময়েই এ টি এম ভাই আমাকে তৈরি করা শুরু করলেন।

প্রশ্ন

এটা কীভাবে?

প্রতিদিন বলতেন, এই বই পড়ো, সেই সিনেমা দেখো, মানুষের মনস্তত্ত্ব পড়ো, সময়কে জানো। এভাবে আমার পড়া চলতে থাকে। তখন এ টি এম ভাই একটি ভাবনা পান। আমি তাঁর সঙ্গে সেই চিত্রনাট্যের বিভিন্ন লোকেশনে ঘুরে চিত্রনাট্য লেখা দেখছি আর বুঝছি। তিনি ধরে ধরে আমাকে দেখাচ্ছেন গ্রামের লোকেরা কীভাবে কথা বলেন, গোসল করেন, চলেন ইত্যাদি। সবাই জানেন, এটি নির্মাণ করবেন আজিজুর রহমান। কিন্তু কোনো এক পয়লা বৈশাখে পত্রিকায় বড় একটা নিউজ। আজিজুর রহমান নিবেদিত ‘লাল কাজল’ পরিচালনা করবেন মতিন রহমান। সেদিনও আমি বোকা-বেকুব হয়েছিলাম। একজন পরিচালক এভাবে একটা ড্রামাটিক মোমেন্ট তৈরি করতে পারেন, এটা আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। মানুষ গড়ার কারিগর আজিজুর রহমান। শুরু হলো আমার যাত্রা। আরেকটি কথা, এ টি এম ভাই আমার আরেকজন শিক্ষক।

‘লাল কাজল’ সিনেমার পোস্টার
প্রশ্ন

এখনো ঘুরেফিরে আমাদের আগের সময়কে বলা হয় সোনালি যুগের সিনেমা। কিন্তু এটাও বলা হয়, সেই যুগে সিনেমা হল আর টেলিভিশন ছিল বিনোদনের মাধ্যম। যে কারণে বাইরের সিনেমা দর্শক তেমন একটা দেখতে না পাওয়ায় বাংলা সিনেমা এতটা সমাদর পেয়েছে, এটা নিয়ে কী বলবেন?

আগের সিনেমার সময়কে সোনালি যুগ বলা ঠিক নয়। এটি নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। এখনো তো কিছু ভালো সিনেমা হচ্ছে বা হবে, তাহলে এটা কি প্লাটিনামের যুগ হবে? আগের সময়কে চলচ্চিত্রের একটি জাগরণের যুগ বলা যায়। তখন দর্শক অনেক সিনেমা দেখতেন, পছন্দ করতেন, বেশ কিছু রুচিসমৃদ্ধ সিনেমা তৈরি হতো। মেধার ভূমিকা ছিল। পরিচালকেরা অনেক কষ্ট করে সিনেমা বানিয়েছেন। সেখানে বাঙালি ঘরানা, বাঙালি সংস্কৃতি, নারী—এসবকে বিষয়বস্তুগত ভাষা নিয়ে সিনেমায় আসত, যার কারণে সিনেমা মানুষের কাছে পছন্দের ছিল। পরে সময়টা বদলে গেল। যে কারণে অবক্ষয় দেখা দিল।

প্রশ্ন

শাবনূরকে আপনার পরিচালিত প্রায় সব সিনেমায় ‘নদী’ নামেই দেখা যায়, কেন সব ছবিতে একই নাম রেখেছিলেন?

সিনেমার টাইটেলের মতো চরিত্রের নামও গুরুত্বপূর্ণ। চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই থাকে নামকরণের অর্থ। আমার সব ছবিতে শাবনূরের চরিত্রের নাম নদী। আমার কাছে গল্পের চরিত্রের সঙ্গে মনে হয়েছে, নদীর প্রবাহ নারীর প্রবাহের মতো। নারী ত্যাগ করে, ভেঙে অন্য গন্তব্য চলে যাচ্ছে। একসময় নারীর যাত্রা শেষ হচ্ছে অন্তিমসাগরে পড়ার মধ্য দিয়ে। এখানে নদী চরিত্রকেও একটা স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আবার সেই একই কারণেই নদীর সব নায়কের নাম ছিল সাগর।

প্রশ্ন

বর্তমান দেশের সিনেমার সবচেয়ে বড় সংকট কী?

গল্প গল্প গল্প। আমরা যাঁরা নির্মাতা, তাঁরা পড়ি না, গল্পচর্চা করি না। কিন্তু সিনেমায় দর্শক গল্প দেখতে আসেন। দর্শকদের গল্প পছন্দ না হলে যতই ক্যামেরা ওঠানামা করানো হোক, তাতে কোনো লাভ নেই।

প্রশ্ন

আপনার কি শিগগির সিনেমায় ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে?

এই মুহূর্তে ফেরার ইচ্ছা নেই। যেহেতু শ্যাম বেনেগাল ৮৮ বছর বয়সে সিনেমা বানিয়েছেন, আবার ৮২ বছর বয়সে আকিরা কুরোসাওয়া সিনেমা বানিয়েছেন। আমার তো মাত্র ৭০। স্বপ্ন আছে আরও সিনেমা বানানোর। দেখা যাক।