বাবা বলতেন, 'আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না'

আইয়ুব বাচ্চু বলেছেন, আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না।
আইয়ুব বাচ্চু বলেছেন, আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না।
>গত বছরের ১৮ অক্টোবর সকালে নিজ বাসায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এলআরবির প্রধান আইয়ুব বাচ্চু। এরপর এলআরবির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন ব্যান্ডের বাকি সদস্য এবং আইয়ুব বাচ্চুর ভক্তরা। এলআরবি নামে আর এই ব্যান্ডের কার্যক্রম পরিচালনা হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। তবে এলআরবির ব্যবস্থাপক শামীম আহমেদ জানান, এলআরবি আবার মঞ্চে আসবে। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর পর কয়েকজন শিল্পীকে দিয়ে মঞ্চ মাতানোর চেষ্টা করা হয়। ৫ এপ্রিল এলআরবি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জানা যায়, বালামকে নিয়ে এলআরবি নতুনভাবে যাত্রা শুরু করছে, তিনিই এখন থেকে এই ব্যান্ডের নতুন ভোকাল। এই ঘোষণার পর এলআরবি-ভক্ত ও শ্রোতাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। শামীম আহমেদ তখন বলেন, ‘ব্যান্ডটিকে আমরা চালু রাখতে চেয়েছি। বসের (আইয়ুব বাচ্চু) ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। তাঁর সবকিছুই আমাদের সঙ্গে আছে। তিনি আছেন, থাকবেন আমাদের মাঝে।’ আজ সোমবার দুপুরে জানা যায়, আইয়ুব বাচ্চুর পরিবারের আপত্তিতে এলআরবি নাম নিয়ে এগোতে চান না অন্য সদস্যরা। এদিকে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এলআরবি যে নতুনভাবে গঠন করা হয়েছে, এসবের নাকি কিছুই জানেন না তাঁরা। এমনকি গত কয়েক মাসে এলআরবি নামে বিভিন্নজনকে দিয়ে স্টেজ পারফরম্যান্স করেছে, এ বিষয়টিও ছিল তাঁদের অজানা। এলআরবি নাম নিয়ে ব্যান্ড এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে পরিবার থেকেও আগেই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা জানান, আইয়ুব বাচ্চু তাঁর অবর্তমানে এলআরবি ব্যান্ডের কী হবে, তা নিয়ে দুই সন্তানকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে আজ সোমবার দুপুরে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে এলআরবি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন ফাইরুজ সাফরা

আপনার বাবার মৃত্যুর পর এলআরবির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল?
যোগাযোগটা খুব কম সময়ের জন্য ছিল। মগবাজারের বাবার চেহলাম অনুষ্ঠানে সবার সঙ্গে শেষ দেখা ও কথা হয়। এরপর আর কোনো যোগাযোগ কিংবা কথা হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, সবার নিজস্ব উন্নয়ন দরকার। আমি যদি প্রত্যাশা করি, আমার পরিবারকে দেখার জন্য সবাই এগিয়ে আসবে; এটা পুরোপুরি ভুল। কারণ সবাই তেমনটা না-ও ভাবতে পারেন। সবাই হয়তো ব্যস্ত হয়ে গেছেন। আমাদেরও অনেক দায়িত্ব ছিল, কারণ বাবা হঠাৎ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কেউ ভাবতেই পারিনি, কী করা উচিত আর কী করা উচিত না। সত্যি কথা বলতে, আমার কাছে পুরো বিষয়টা এখনো অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। আব্বুর গান এখনো স্বাভাবিকভাবে শুনতে পারি না। আব্বুকে নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে কষ্ট হয়।

এলআরবি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন আইয়ুব বাচ্চুর মেয়ে ফাইরুজ সাফরা

ব্যান্ডে নতুন সদস্য নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গে এলআরবির কেউ কথা বলেছেন?
না। বাবা মারা যাওয়ার পর প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাঁর ফেসবুকটা দেখি। বাবার সঙ্গে ইনবক্সে বলা কথাবার্তা দেখে একটু শান্তি খোঁজার চেষ্টা করি। মনে হয়, আব্বু এখনো আমার সঙ্গে আছেন। একদিন দেখি, বাবার ফেসবুক প্রোফাইল নাই। অবাক হই, কী হলো! এরপর আমার ভাইকে কানাডায় ফোন করি। তাঁকে বললাম, তুমি বাবার ফেসবুক প্রোফাইল চেক করো। ও চমকে যায়। আমার স্বামীকে দিয়েও চেক করি। এরপর বাংলাদেশে মাকে ফোন করি। মা চেক করেন। আব্বুর ফেসবুক দেখতে পাচ্ছি না। এর মধ্যে ফেসবুক লাইভে জানতে পারি, এলআরবি ব্যান্ডে নতুন সদস্য নেওয়া হয়েছে! নতুনভাবে এলআরবি গঠন করা হয়েছে। খুব অবাক হয়েছি। আম্মুও অবাক।

আইয়ুব বাচ্চুর অবর্তমানে তাঁর ব্যান্ডের কী হবে, এসব নিয়ে তিনি কখনো কিছু বলেছেন?
বাবা সব সময় বলতেন, ‘আমাকে ছাড়া এলআরবি চলবে না। আমার এই সম্পদের অধিকার শুধু তোমার আর তোমার ভাইয়ের।’ বাবা একটা কথা সব সময় পরিষ্কার করে বলতেন, ‘আমি তোমাদের খুব গরিব বাবা। আমার অনেক সীমিত জিনিস। আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ আমার ছেলে ও মেয়ে। জীবনে অনেক শ্রম দিয়ে তোমাদের লেখাপড়া করিয়েছি।’ বাবার এই কথা আমি সব সময় মনে রেখেছি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি না থাকলে, আমার কোনো জিনিসকে কখনো উল্টাপাল্টা হতে দিবা না।’ দাদু মারা যাওয়ার পর বাবা বলেছিলেন, ‘আমি মারা গেলে আমাকে মায়ের পাশে কবর দিয়ো।’ তখন রাগ করে বাবাকে বলছিলাম, ‘ফালতু কথা বইল না।’ এসব নিয়ে কেন চিন্তা করছি? সন্তান হিসেবে দেশের বাইরে বসে কিছুই করতে পারছি না। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। মা বাংলাদেশে, আমি অস্ট্রেলিয়ায় আর ভাই কানাডায়।

আইয়ুব বাচ্চু সন্তানদের বলেছেন, আমি তোমাদের খুব গরিব বাবা।

ব্যান্ডের নতুন লাইনআপ চূড়ান্ত করার আগে কয়েকটা শোতে বিভিন্ন শিল্পী নিয়ে এলআরবি পারফর্ম করেছে?
এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আম্মুও জানে না। বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি, এলআরবি নাকি অন্য ভোকাল নিয়ে পারফর্ম করছে। আমি মনে করি, ‘ভদ্রতা’ বলে একটা কথা আছে। সহ্যের বাইরে যখন চলে গেছে, তখন মনে হয়েছে এটা নিয়ে কথা বলা উচিত। কারণ আমি ঢাকায় নাই। কিছুই করতে পারছি না। কাউকে তো বলা উচিত। ভেবেছিলাম, আমাদের বাবা হারানোর কষ্ট হয়তো তাঁরা বুঝবে। আমরা ওই সময়টা কীভাবে পার করেছি, তা তাঁরা দেখেছে। তাঁরা অন্তত আমাদের জানাতে পারত।

আইয়ুব বাচ্চুর ফেসবুক আইডি তো হ্যাক হয়েছিল।
এই ঘটনায় আমরা অবাক হয়েছি। মানুষটা নাই, তাঁর ফেসবুক হ্যাক করার কী মানে! যাঁরা করেছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য মোটেও সৎ ছিল না। ফেসবুকে আমার বাবার অনেক স্মৃতি ছিল। বিভিন্ন শোর উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত ছিল। আমি তো বলব, বাবার স্মৃতি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বাবার সঙ্গে আমার কথাবার্তা কিছুই দেখছি না। জানি না, কার কাছে গেলে এগুলো ফিরে পাব। ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে মেইল করেছি। দেখি কী জবাব আসে!

চট্টগ্রামে বাবাকে নিয়ে গান গাইতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আহনাফ তাজওয়ার ও ফাইরুজ সাফরা

এলআরবি না থাকলে আইয়ুব বাচ্চুকে সবাই একদিন ভুলে যাবে—আপনি তেমনটা মনে করেন?
এটা মোটেও ঠিক না। মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মধ্যে। আইয়ুব বাচ্চুর নাম যত দিন থাকবে, তাঁর সঙ্গে এলআরবিও উচ্চারিত হবে। এ দুটি সমার্থক শব্দ। বাবার ব্যান্ড যদি আর না চলে, তারপরও ভক্ত-শ্রোতারাই এটাকে বাঁচিয়ে রাখবেন। কারণ এটা বাবার সৃষ্টি। বাবার ব্যান্ডের সদস্যরাও জড়িত ছিল, এটা আমরা বুঝি। কিন্তু ব্যাপারগুলো এত আজব হয়ে যাচ্ছে, যা আমাদের কাছে মোটেও স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। এ কারণে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আসলে তাদের সঙ্গে না, একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলেছি। এরপরও ব্যান্ডের কোনো সদস্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

কার সঙ্গে কথা বলেছেন?
তাপস চাচ্চুর (কৌশিক হোসেন তাপস) সঙ্গে কথা বলেছি। সব সমস্যা তাঁকে জানিয়েছি। তিনি আমাদের কাছে জানতে চান, সন্তান হিসেবে আমাদের সিদ্ধান্ত কী? এলআরবি সদস্যরা কীভাবে চলবে? আমি বলেছিলাম, বাবা নেই। বাবা আমাদের জন্য কোনো ব্যবসা রেখে যাননি। আমরা বিদেশে আছি, কেউ একবারও জানতে চায়নি আমরা কীভাবে চলছি। এরপরও যখন জানতে চেয়েছেন, বলেছি, বাবার কথা ভেবে কাউকে অনুমতি দিতে পারছি না। মঞ্চে যে কেউ বাবার গান গাইতে পারবে। তারা জিরো থেকে নতুন একটা ব্যান্ড গঠন করুক। তাতে আমাদের বাধা দেওয়ার কিছু নেই। যে যেভাবে বাবাকে চায়, ট্রিবিউট জানাতে পারবে, সেখানে আমরা বাধা দেওয়ার কেউ না।

আইয়ুব বাচ্চু

এবি কিচেনের কী অবস্থা?
মা একা বাবার নতুন অফিস গুছিয়েছেন। বাড়ির মালিক অনেক দিন ধরে এবি কিচেনের আগের স্টুডিও সরিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। বিষয়টি জানার পর শামীম আংকেলসহ ব্যান্ডের সব সদস্যকে আম্মু বারবার অনুরোধ করেছেন, অফিস বদল করার সময় সঙ্গে থাকার জন্য। কিন্তু কেউ আসেনি। আম্মু আমাকে বলেছেন, সবাইকে ডাকি, কেউ তো আসে না। এবি কিচেন শিফট করতে আম্মুকে সহযোগিতা করেছেন আমাদের ড্রাইভার, বাবার অফিসের সহযোগী ছেলেটা, অফিস ব্যবস্থাপক আর বাবার বন্ধু দুলাল আংকেল। আর কেউ ছিল না।

আপনার বাবার অনেকগুলো গিটার আছে। সেগুলো নিয়ে কী করতে চান?
যদি অনেক টাকা জমাতে পারি, প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, তবে বাবার সব গিটার নিয়ে একটা হার্ড রক ক্যাফে করব।

আরও পড়ুন: