>
বেলায়াত হোসেন মামুন। চলচ্চিত্রনির্মাতা, লেখক ও সংগঠক। তিনি ম্যুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। বর্তমানে তিনি ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি এবং আরও অনেকে একত্রে সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদ’ নামের একটি সংগঠনের গোড়াপত্তন করেছেন।
বিভাগীয় পর্যায়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের সম্মেলন আয়োজনের একটি উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। সিলেট ও রাজশাহীতে সম্মেলন শেষ করেছেন। এই সম্মেলন আয়োজনের কারণ কী?
বাংলাদেশের তরুণ ও নবীন চলচ্চিত্রকর্মীদের একত্র করার উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদের উদ্যোগে আমরা গত ৪ মে সিলেটে এবং ১১ মে রাজশাহীতে সম্মেলন আয়োজন করেছি। এ দুটি সম্মেলনে সিলেট বিভাগের ৪টি জেলার এবং রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলার চলচ্চিত্রকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পর্ষদের সিলেট বিভাগীয় কমিটি ও রাজশাহী বিভাগীয় কমিটি গঠিত হয়েছে। ঈদের পর জুন মাসে আরও ৩টি বিভাগীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ১৫ জুন চট্টগ্রামে, ২২ জুন খুলনায় এবং ২৯ জুন রংপুরে চলচ্চিত্রকর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে দেশের ৮টি বিভাগীয় সম্মেলন শেষ করে আমরা চলচ্চিত্রকর্মীদের জাতীয় সম্মেলন আয়োজন করবে।
আপনি ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের ইশতেহার’ লিখেছেন। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
দেখুন, ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন’ একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ আন্দোলন। সময় বদলেছে, প্রযুক্তির ধরন বদলেছে। নতুন এই সময়ে বাংলাদেশের পুরো চলচ্চিত্র কাঠামোর রূপান্তর ঘটতে যাচ্ছে। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় আমরা ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের’ প্রসঙ্গ তুলে ধরেছি। ইশতেহারটি শিগগিরই বই আকারে মুদ্রিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দিনের বাংলাদেশে তরুণ ও নবীন চলচ্চিত্রকর্মীরা মানুষের স্বাধীন সত্তার কথা বলবে, লড়বে এবং স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলনের জন্য তৈরি হবে। নতুন সময়ে নতুন আন্দোলনের ডাক আমরা দিয়েছি।
আপনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকে বলছেন ‘জাতীয় চলচ্চিত্র তিরস্কার’, আবার চলচ্চিত্র অনুদান নিয়েও আপনার সরব প্রতিবাদ দেখতে পাই। আপনার অভিযোগগুলো কী?
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র তিরস্কার’ বলেছিলেন শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। আমি কথাটিকে যথার্থ মনে করি, তাই বলি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের যে মান ও মর্যাদা থাকা দরকার ছিল, তা নেই। একটি দেশের ‘জাতীয়’ মান কেমন হবে, তা সেই জাতির শ্রেষ্ঠ মানুষজন ঠিক করবেন। বাংলাদেশে ফি বছর যেসব চলচ্চিত্রকে যেসব ক্যাটাগরিতে গুচ্ছ গুচ্ছ পুরস্কার দেওয়া হয়, তা চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক মানের দিক থেকে খুব নিম্নমানের। তাই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার আদতে জাতীয় ‘তিরস্কার’ হয়েই আমাদের সামনে হাজির হয়। হয়তো কোনো এক সময়ে আমরা এসব ছবি এবং এসব পুরস্কার নিয়ে সবাই মিলেই লজ্জা পাব। আপাতত আমরা কয়েকজন সেই লজ্জা অনুভব করছি। আর চলচ্চিত্রে অনুদান! কী বলবে! আজ পর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি ছবি ছাড়া প্রায় সব অনুদানের চলচ্চিত্রই বাজে চলচ্চিত্র হয়েছে। দায়সারা গোছের কিছু কাজ যেন, এটা কিন্তু ভীষণ হতাশাজনক একটি চিত্র। আর এবার তো চলচ্চিত্রের অনুদান নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পাহাড় ছুঁয়েছে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র—দুই ক্যাটাগরিতেই অনিয়মের অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন এতটাই দুর্নীতিগ্রস্ত যে পাঁচ কোটি টাকা হোক আর পাঁচ হাজার কোটি, তাতে কোনো পার্থক্য নেই। দুর্নীতি হবেই। চলচ্চিত্র অনুদান প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয় প্রণীত নিয়ম ও বিধি অনুযায়ী হচ্ছে না।
আপনি ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০১৯’-এর বিপক্ষে?
আমি ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০১৯’–এর বিপক্ষে নই, আমি এই আইনের প্রস্তাবিত খসড়ার সমালোচক বলতে পারেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে বন্দী করতে ব্রিটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীন মুক্ত বাংলাদেশে যত আইন পাস হয়েছে, তার সব কটিই মূলত দমনমূলক আইন। ‘চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০১৯’-এর খসড়াটি আমরা পড়েছি। সেখানে চলচ্চিত্রের জন্য নেতিবাচক ধারাগুলোই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এমন একটি আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে, যেখানে প্রজাতন্ত্রের আমলারা ঠিক করবেন কোন চলচ্চিত্রটি চলবে অথবা কোন চলচ্চিত্রটি চলবে না। কোথায় চলবে, কোথায় চলবে না। এসব সিদ্ধান্ত তাঁদের দেওয়ার কথা নয়। এই খসড়ায় এমন কথাও লেখা হয়েছে, যাতে আমলারা চাইলে কোনো চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেট বাতিল করে দিতে পারবেন। এই আইনের খসড়ায় সার্টিফিকেশন এবং গ্রেডিং পদ্ধতি রেখে কেবল আইওয়াশ করা হচ্ছে। পুরোটাই শুভংকরের ফাঁকি।
সার্বিকভাবে দেশের চলচ্চিত্রের জন্য কী করা উচিত?
প্রথমত সরকারের উচিত চলচ্চিত্রের চর্চাকে ‘সংস্কৃতি’ হিসেবে ঘোষণা করা। আমরা বহুদিন ধরে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানাচ্ছি। সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রস্তাব জমা দিয়েছি। এ ছাড়া গত ৩ এপ্রিল ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের ভালো পরিবেশ তৈরি করতে হলে অবিলম্বে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। চলচ্চিত্রের চর্চা ছাড়া চলচ্চিত্রের উন্নতি কোনোভাবেই হতে পারে না।
‘জাতীয় চলচ্চিত্র কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সরকারের উচিত দেশের তরুণ ও নবীন চলচ্চিত্রকর্মীদের সব ধরনের উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান করা। তাদের জন্য চলচ্চিত্রচর্চা ও নির্মাণের সহায়ক পরিবেশ গড়ে দেওয়া। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাতাবরণের বদল কিন্তু তরুণদের হাতেই হবে। বাংলাদেশের তরুণ ও নবীন চলচ্চিত্রকর্মীদের প্রতি আমার সেই বিশ্বাস রয়েছে।