দুজনে সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রেমে পড়ে যাই

ভালো আছি। ৮৫ বছরে যতটা ভালো থাকা যায়, ততটা আছি। তবে বয়সের ব্যাপারটা মাথায় আনি না বলেই এখনো চলতে–ফিরতে পারছি।

তাই নাকি, আমি তো মুক্তির তারিখটা ভুলে গেছি। আমার স্মরণশক্তি এখন খুব কমে গেছে। তবে মোটামুটি চলতে–ফিরতে পারি। তোমার কাছে শোনার পর খবরটা সত্যি খুব ভালো লাগছে।

’৫৩-৫৪ সালের কথা। তখন আমি ইডেন কলেজে পড়ি। আমার বান্ধবী জহরত আরা (মুখ ও মুখোশ ছবিতে অভিনয় করেছে)। আমরা ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলাম। পুরান ঢাকায় পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছি। জানতে পারলাম, জব্বার সাহেব সিনেমার জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছেন। বাড়িতে কাউকে না বলে চুপি চুপি দুজনে পরামর্শ করে আগামসিহ লেন নবাব কাটরার ইকবাল ফিল্মসের অফিসে যাই। বাড়ির কাছেই ছিল অফিসটা। দু-এক দিন গিয়েছি, কথা বলেছি।। আরেক দিন যখন ডাক পড়ল, সেদিন কলকাতার ক্যামেরাম্যান মুরলিমোহনও ছিলেন। স্ক্রিন টেস্টে দুজনে অ্যালাউ হলাম। মনে মনে তো দুজনে খুবই খুশি। এরপর বললেন, শুটিং কবে হবে জানাবেন। আমরা তো গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তত দিন পর্যন্ত আমরা বাড়িতে কেউ কিছু বলিনি। কারণ, আমার বাবা একটু ধার্মিক ছিলেন, জানি যে সিনেমায় অভিনয় করতে দেবেন না। তবে রেডিওতে কাজ করলে কিছু বলতেন না। শিক্ষামূলক একটি অনুষ্ঠানে আমি থাকতাম।

নাটক করতাম। কবি জসীমউদ্‌দীন সাহেবের সঙ্গে আমার ভালো পরিচয় ছিল। তাঁর একটা নাটক ছিল বেদের মেয়ে, আমরা একটা গ্রুপ এই নাটক নিয়ে কলকাতায়ও গিয়েছিলাম। ঢাকায় আরও কয়েকটা নাটকে অভিনয় করেছি। কার্জন হলে একদিন জব্বার সাহেব নাটকটি দেখতে গিয়েছিলেন। বেদের মেয়ে নাটকে মোড়লের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছি। জব্বার সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, বেদের মেয়ে নাটকটি তিনি দেখতে গিয়েছিলেন। প্রশংসাও করেছিলেন। ভারতেশ্বরী হোমসে পড়ার সময়ও নাটক করতাম, নাচের অনুষ্ঠান করতাম, গান গাইতাম।

বাবা যেতেন না। এসবে খুব একটা উৎসাহও দিতেন না। বাবাকে এসবে পটিয়ে–পটিয়ে কোনোরকমে রাজি করিয়ে নিতাম। কিন্তু সিনেমার ব্যাপারটা আগে মোটেও জানাইনি। তাই ব্যাপারটা অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল।

যখন আমরা সিলেক্ট হলাম, মাঝে মাঝে ইকবাল ফিল্মসের অফিসে যেতাম। তখনকার দিনে তো পর্দানশিন সমাজ। বেশিক্ষণ বাইরে থাকতেও দিত না। সিনেমার আড্ডার আসর বসে তো সন্ধ্যার সময়। আমরা জব্বার সাহেবকে বলে সন্ধ্যার আগে কাজ সেরে চলে আসতাম। তখন [সৈয়দ মোহাম্মদ] পারভেজ সাহেবের একটা ম্যাগাজিন ছিল, চিত্রালি। এই ম্যাগাজিনে মুখ ও মুখোশ সিনেমার নির্বাচিত সব অভিনয়শিল্পীর ছবি ছাপানো হয়। একটা শুভেচ্ছাসংখ্যা আমাদের বাসায়ও পাঠানো হয়। ম্যাগাজিনটা পড়ে বাবার হাতে। ডাকলেন, মা, একটু আসো তো, তোমার সঙ্গে কথা আছে। আমি তো বাবার এমন ডাক শুনে ভয় পেয়ে গেছি। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা, কী হইছে? বাবা ম্যাগাজিন খুলেই বললেন, দেখো তো মা, এটা কার ছবি? বাবা এমনিতে খুব অমায়িক ছিলেন। আমি তো ভয়ে কাঁপছি তখন। আমি বললাম, বাবা, আপনি তো জানেন, এটা কার ছবি? এরপর বাবা বললেন, তোমরা এত দূর অগ্রসর হলে কেমন করে! বাসায় কিছু বললা না! এই কাজটা তো তুমি মোটেও ঠিক করোনি। সিনেমায় তুমি নাম দিয়েছ, সিনেমায় অভিনয় করবে, আমাদের সমাজ এটা ভালো করে দেখবে না। অনেকে আমাকে অনেক রকম কথা বলবে, তোমাকেও বলবে। তুমি সিনেমাটা করতে পারবা না। তত দিনে শুটিং কবে, কখন শুরু হবে—সব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। প্রস্তুতিও শেষ।

বান্ধবীর বাড়ি যাব বলে একদিন জহরত আরা ও আমি জব্বার সাহেবের কমলাপুরের বাড়িতে গেলাম। বললাম, বাবা তো সিনেমায় কাজ করতে দেবেন না। তিনি ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। জব্বার সাহেব বললেন, এখন তো নারাজ হলে হবে না। সবই রেডি। শুধু শুটিংয়ে যাওয়া। শুটিং করা। তখন আমরা দুজনেই বললাম, আপনি একটু আমাদের বাড়িতে যান, বাবাকে বুঝিয়ে বলেন। জহরত আরার বাবাকে রাজি করানো হলো। আমার বাবাকে রাজি করানোই যাচ্ছিল না। বাবাকে তিনি বললেন, একটাবার সুযোগ দেন। এরপর আপনার মেয়েকে আর বই করতে দিয়েন না। অনেক কষ্টে তিনি রাজি হলেন।

টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে। পরে কমলাপুর বৌদ্ধমন্দিরের ভেতরে একটি পুকুর আছে, সেই পুকুরে গানের শুটিং করেছিলাম। সব মিলিয়ে ছবির শুটিং শেষ হতে মাসখানেক লেগেছিল।

আমার কাছে তো খুবই ভালো লাগত। আমরা দুই বন্ধু ছিলাম বলে ভালো লাগাটা বেশি কাজ করেছে। প্রথম শুটিংয়ের দিন, আমার বুকের ভেতরে খুব কম্পন হচ্ছিল। কীভাবে ডায়ালগ বলব। কীভাবে স্টেপ নেব—এসব ভাবতে ভাবতেই অবস্থা শেষ। কোনো দিন তো ভাবিনি, সিনেমায় অভিনয় করব। অনেক কষ্টে শুটিং করেছি, তার আগে শুটিং সম্পর্কে ধারণাই ছিল না।

সদরঘাট রূপমহল সিনেমা হলে ছবিটি দেখেছি। সব অভিনয়শিল্পীকে জব্বার সাহেব ডেকেছিলেন। অনেক নামীদামি অতিথিরাও ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ছবিটির উদ্বোধন করেন। আমি অবশ্য জানি না, ওই সিনেমা হল এখন আছে কি না।

সিনেমা শুরু হলো, ভেতরে আলোড়ন সৃষ্টি হলো। কেমন হবে, আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম, যেন ভালো হয়। যাহোক, প্রথম আমাকে দেখাল, সম্পূর্ণ দেখলাম, নিশ্বাস আর পড়ে না। দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। সম্পূর্ণ ছবি শেষ হওয়ার পর খুব ভালো লাগল। মনে মনে অনেক খুশি হলাম। ভাবলাম, আমি সার্থক। চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে পেরেছি, সেটা পর্দায় দেখানো হয়েছে। তখনকার দিনে ছবিটি ব্যাপক সাড়াও ফেলেছিল।

বাবাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, নাকি কার সঙ্গে গিয়েছিলাম, মনে পড়ছে না।

মা–ও বাবাকে সায় দিতেন। বাবা যা যা বলতেন, মা হ্যাঁ হ্যাঁ করতেন। আমার মা–ও সাধারণ ঘরোয়া মানুষ। তিন ভাই ছোট ছিল, ওরাই শুধু উৎসাহ দিত। বড় আপা হ্যাঁ–ও বলতেন না, না–ও বলতেন না। ইমিডিয়েট বড় বোনও কিছুই বলতেন না।

আরও কয়েকটি সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলাম। বাবা রাজি হলেন না। এর মধ্যে বিয়ে হয়ে গেল। আমার বর আমিনুল হক ও আমি একই সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম। দুজনে সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে প্রেমে পড়ে যাই। অনেক দিনের প্রেম। বছর দুই-তিন চুপি চুপি প্রেম করেছি আমরা। এরপর দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হলো। তারপর বিয়ে হয়ে যায়।

বাসায় ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যেতাম। আমাদের দেখা–সাক্ষাৎ হতো কম। ইকবাল ফিল্মসের অফিসে আমাদের প্রথম দেখা। ওখান থেকে একটু একটু করে ভালো লাগা। এরপর সম্পর্ক গভীর হওয়া।

আমিনুলই প্রথম প্রস্তাব দেয়। আমি তো চুপচাপ ছিলাম। ভালোবাসি কথাটা আগে ওর মুখ থেকে শুনেছি। ওর চলাফেরা, কথাবার্তা, চেহারা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু বলতে পারিনি।

তিনি নিজে সিনেমায় অভিনয় করেছেন ঠিকই, কিন্তু আমাকে দেননি। কেনর উত্তর আমি দিতে পারব না। কেন দেবে না, এটা নিয়ে আমিও আর ওর সঙ্গে কথা বলিনি। কারণ, আমি একটু শান্তশিষ্ট ছিলাম। তবে এটুকু বুঝতে পারতাম, আমিনুল হকের ইচ্ছে ছিল না আমাকে অভিনয়ে দেখার। চান্দা সিনেমায়ও আমাকে অফার দিয়েছিল। এই প্রস্তাব সে নাকচ করে দেয়। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও চাইত না।

আমার কোনো মনঃকষ্ট ছিল না। এটাকে আমি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছি। ঘরোয়াভাবে যে রকম থাকি, তেমন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।

আমার কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তবে আমিনুল হকের সঙ্গে সবার যোগাযোগ ছিল। তার কাছে খবরাখবর শুনতাম। আমি কোনো অনুষ্ঠানেও যেতাম না। ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

আমাকে চাকরিবাকরিও করতে দেয়নি। ইডেন থেকে ইন্টার শেষ করে, প্রাইভেট থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি।

শুনে আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ওর সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। লন্ডনে ওর বাসায় বেড়াতেও গিয়েছিলাম। করোনার মধ্যে আর আমাদের যোগাযোগ হয়নি। তখন অসুস্থ ছিল। হোম কেয়ারে ছিল।