ট্রেলার দিয়ে গোটা সিনেমা জাজ করা কোনো বিচক্ষণতা নয়

কান চলচ্চিত্র উৎসবের ৭৫তম আসরে ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন’-এর ট্রেলার প্রদর্শিত হলো। ওই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সেখানে গিয়ে হাজির হন মুজিব চরিত্রের অভিনেতা আরিফিন শুভ। ট্রেলারটি নিয়ে গত কয়েক দিন ফেসবুকে চলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমা, কান চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাসহ নানা বিষয়ে ফ্রান্সের কান শহর থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন এই অভিনেতা।

আরিফিন শুভ
আরিফিন শুভ
প্রশ্ন

কেমন কাটছে?

আমি অনেকটা বিধ্বস্ত। ২০ মে পর্যন্ত অফিশিয়াল শিডিউল নিয়ে আমরা এখানে এসেছি। ট্রেলার দেখানোর পর থেকে অন্যান্য সিনেমা দেখা, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা, সাক্ষাৎকার দেওয়া, প্যাভিলিয়ন থেকে অ্যাপার্টমেন্ট, অ্যাপার্টমেন্ট থেকে প্যাভিলিয়নে যাওয়া-আসার মধ্যে আছি। বিশ্রাম নিতে পারছি না। গত দুই দিন আমন্ত্রণ পেয়ে দুটি ছবি দেখলাম। একটি অস্ট্রেলিয়ান পরিচালক জজ মিলারের ‘থ্রি থাউজেন্ড ইয়ারস অব লংগিং’, আরেকটি ভারতীয় পুশান কৃপালনীর ‘গোল্ডফিশ’।

প্রশ্ন

ছবি নয়, ‘মুজিব’ ছবির ট্রেলার নিয়ে কান চলচ্চিত্র উৎসবে গেলেন। কেমন লাগছে?

আমার জন্য এটি দারুণ একটি ব্যাপার। এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে চেনাজানা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এখানকার পরিবেশ এমন যে পাশের মানুষটি আপনার অপরিচিত হলেও অবলীলায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন, আলোচনা করতে পারবেন। তাঁরা হয় চলচ্চিত্র সাংবাদিক, নয়তো প্রযোজক, পরিবেশক, রাইটার কিংবা পরিচালক। গান্ধী বা নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে বানানো সিনেমা যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গেছে, মানুষ সেটা দেখেছেন, তাঁদের সম্পর্কে বিশদ জেনেছেন। আমি যেখানেই গিয়েছি, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলেছি, এটি আমার বড় প্রাপ্তি।

প্রশ্ন

‘মুজিব’-এর ট্রেলার দেখে সেখানকার দর্শনার্থীদের প্রতিক্রিয়া কী?

পরপর দুবার ট্রেলারটি দেখানো হয়েছে। সে সময় ভারত, বাংলাদেশসহ, ডাচ, কানাডীয়, জার্মান, কোরীয় সিনেমার মানুষেরা ছিলেন। একটা জিনিসই তাঁরা বলেছেন, ‘উই কান্ট ওয়েট টু ওয়াচ দ্য ফিল্ম।’ প্রিমিয়ারের পর একটা পার্টি হয়, সেখানে একে–অপরের সঙ্গে পরিচিত হন, কথা বলেন, নিজেদের গল্প বলেন, কে কোথা থেকে এসেছেন, সবার পেশা কী, নিজেদের দেশের সিনেমাসহ নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে আমি এই ছবিটি ধরে শ্যাম বেনেগালের কাজ, শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা, কোভিড সিচুয়েশনে কাজ করা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছি। এসব জানার পর সেখানকার সবাই ছবিটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

প্রশ্ন

কিন্তু ট্রেলারটি ইউটিউবে প্রকাশের পর ফেসবুকে তুমুল আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে। আপনি কি দেখেছেন? বলতে চাইছি, ফেসবুকে মানুষের প্রতিক্রিয়ায় দেখা গেছে, বেশির ভাগ দর্শকেরই ট্রেলারটি ভালো লাগেনি। আপনার উপস্থিতির অংশটুকুও খুব একটা ভালোভাবে নেননি তাঁরা।

হ্যাঁ, এসবের খবরও রাখি। ফেসবুকে দেখেছি, অনেকের কাছ থেকে শুনেছিও। ট্রেলার নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সবাই খারাপ বলছেন বা সবাই ভালো বলছেন, এমন নয়। দর্শকের মন্তব্য করার অধিকার আছে। আমি সেসব মাথা পেতে নিচ্ছি। আবারও বলছি, এত সমালোচনার পরও কিন্তু দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে ছবিটি সবাই দেখতে চান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি ছবি হয়েছে, সেটা কী হয়েছে, কেমন হয়েছে, তা সবাই দেখতে চান। এই উপমহাদেশে শ্যাম বেনেগাল একটি অনন্য নাম। তিনি, অতুল তিওয়ারি, শামা জায়েদীসহ বাংলাদেশের এফডিসি, ভারতের এনডিসি এই ছবির সঙ্গে জড়িত। তবে একটা ট্রেলার দিয়ে গোটা সিনেমা জাজ করা কোনো বিচক্ষণতা নয়। পুরো ছবিটি দেখে যদি মনে হয়, আরিফিন শুভ তার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, সেটা দেশের মানুষের জন্য এনাফ হওয়া উচিত। শুভ ছবিটি লেখেনি, ক্যামেরা চালায়নি, পরিচালনা করেনি। শুধু একটা চরিত্র প্লে করেছে। শুভ সেটা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে করেছে কি না, বেস্ট দিতে পেরেছে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।

প্রশ্ন

সমালোচনাকারীরা বলতে চেয়েছেন, ছবির কালার-গ্রাফিকস, অ্যানিমেশনের অংশটুকু যথাযথভাবে করা হয়নি।

যখন একটি রান্নাঘরে আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য রান্না হয়, সেখানে আলাদা করে একজনের জন্য রান্না করা যায় না। আমাদের ছবির পোস্ট–প্রোডাকশনের কাজ এখনো চলছে। এ নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, অথচ আমি এ ছবির একজন অভিনয়শিল্পী। ছবির পোস্ট–প্রোডাকশনে কাজ একজন শিল্পীর হাতে থাকে না। একজন শিল্পী সেটে তাঁর সর্বোচ্চটুকু দেন। আমিও দিয়েছি। আর এটি অফিশিয়াল ট্রেলার না।

প্রশ্ন

আন-অফিশিয়াল একটা ট্রেলার কানে নেওয়া কি ঠিক হয়েছে?

এ প্রশ্নের সহজ–সরল উত্তর হলো, আমাদের ছবির শুটিং ও পোস্ট–প্রোডাকশনের কাজ হয়েছে ভিন্ন দুটি সময়ে। পোস্ট–প্রোডাকশনটা যদি এক বছর আগে থেকে শুরু করা যেত, তাহলে আজ আমাদের হাতে অফিশিয়াল ট্রেলার থাকত। কান উৎসবটি আমরা ধরতে চেয়েছি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে কিছুটা অ্যাটেনশন নেওয়ার জন্য। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। তাই হাতে যেটা ছিল, সেটা নিয়েই কানের মঞ্চে এসেছি। বিশ্বমঞ্চের সিনেমার মানুষেরা এই ছবি নিয়ে কথা বলছেন, এটাও ছবিটির জন্য একটা প্রচারণা। এখানে এসে পৃথিবীর অন্য প্রান্তের দুটি মানুষও যদি ছবিটি সম্পর্কে জানতে পারেন, সেটাও তো ছবির জন্য ভালো। ছবিটি সেপ্টেম্বর মাসে মুক্তি পাবে। চার মাস আগে তো অফিশিয়াল ট্রেলার করা সম্ভব নয়।

প্রশ্ন

কান উৎসব থেকে ব্যক্তি শুভর প্রাপ্তি কী?

আমি প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়েছি। আমি আমার কাজ নিয়ে পৃথিবীর সামনে, এই জায়গায় বারবার আসতে চাই। দেখুন, ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্যারিসের সাংবাদিক, লেখক নূর আউয়াল ৩০ বছর ধরে কানে আসেন। তাঁর সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম, তখন তিনি বলছিলেন কোরিয়ান একটি ফিল্ম অস্কারে যাচ্ছে, অস্কার জিতছে, এটি কিন্তু দুই দিনের চেষ্টায় নয়। ৩০ বছর ধরে কোরিয়ান ইন্ডাস্ট্রির লোকজন কানে উপস্থিত থাকেন। তাঁর কথা, সিনেমার আন্তর্জাতিক এক্সপোজার চাইলে আমাদেরও প্রতিবছর এই জায়গায় আসতে হবে। এখানে এসে আমি এ–ও শুনেছি, আমাদের সিনেমার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আছে।