বরেণ্য চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ২৯ বছর আগে নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই থেকে চলচ্চিত্রের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত আছেন তিনি। সমাজসেবায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৮ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। এবার তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে কাঞ্চন-নিপুণ প্যানেল থেকে সভাপতি পদে নির্বাচন করছেন। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং দেশের চলচ্চিত্র শিল্প তার ভাবনা এই সাক্ষাৎকারে জানার চেষ্টা করা হয়েছে
অভিনয়ের পাশাপাশি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। এবার দেখা গেল আপনি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে প্যানেল দিয়েছেন। সমিতি কি এতটাই অনিরাপদ হয়ে ওঠল যে আপনাকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি নিয়েও ভাবতে হচ্ছে।
দেশে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি ও চলচ্চিত্রের অন্য যেসব সমিতি আছে-এসবের মধ্যে অনৈক্য রয়েছে। চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নের এই অনৈক্য দূর করা জরুরি। ঐক্য না থাকার কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। চলচ্চিত্র বেশি নির্মাণ না হওয়ার কারণে সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দেশের সিনেমাহলের জন্য এক হাজার কোটি টাকা দিলেও হলমালিকেরা সেই টাকা নেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। কারণ, মুক্তি দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত চলচ্চিত্র নেই। হলমালিকদের বক্তব্য, সিনেমাই যেখানে নেই, সেখানে কেন সুদে টাকা নেব? একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে চাই, আমরা শিল্পীরা কিন্তু সব সময় চলচ্চিত্রের উন্নয়নের চেষ্টা করি। তবে বর্তমান শিল্পী সমিতি সেই কাজ করছে না। সবার মনে আছে কি না জানি না, আমরা ক্যাপাসিটি ট্যাক্স দূর করার জন্য আন্দোলন করেছি। সেই ট্যাক্সের আন্দোলনে আমাদের রাজ্জাক ভাই, আলমগীর ভাই, ফারুক ভাই, পারভেজ ভাই, আমিসহ-আমরা কিন্তু মারও খেয়েছি। পরবর্তী সময়ে আন্দোলন সাকসেস হয়েছে। সাকসেস হওয়াতে ছবির সংখ্যা বেড়েছে। এমন সংখ্যা বেড়েছিল যে শুটিংয়ের সময় এফডিসির ক্যামেরা সেকশন থেকে ক্যামেরা নিতে হলে ঘুষ দিয়ে রাখতে হতো। লাইট নিতে গেলেও একই অবস্থা হতো। আমাদের শিল্পী-সম্মানীও বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমাদের তখন একদম রমরমা অবস্থা। ডাইরেক্টর, প্রডিউসার, আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ানরা রমরমা অবস্থা পার করেছি। সেই জায়গা থেকে বলতে চাই, ফিল্মের যেকোনো ক্রাইসিস যখনই আসে, তখন শিল্পীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, তাদেরকে মানুষ চেনে। তাদের ডাকে মানুষ রাস্তায় আসে। এমনকি সরকার ও সরকারের আমলারা শিল্পীদের চেনেন। চলচ্চিত্রের এখনকার অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিল্পীসমাজ যদি এগিয়ে না যায়, তাহলে তো এর উত্তরণ ঘটবে না। এখন যেসব শিল্পী বেকার, যাদের কাজ নেই, তাদের যদি আটা, গম, চাল ডিস্ট্রিবিউট করেন-এ দিয়ে কত দিন আপনি তাদের বাঁচিয়ে রাখবেন, কিংবা ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখবেন। ক্যাপাসিটি ট্যাক্সের সময় কাজ বাড়ানোর জন্য শিল্পীরা যে রকম আমরা মার খেয়েছি প্রয়োজনে, এখনকার সংকট দূর করতেও আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। আমাদের এখন পলিসি তৈরি করতে হবে। এটা মনে করেই আমি এসেছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির প্রতি কিন্তু আলাদা একটা মমত্ববোধ আছে। এখানে এক হাজার কোটি টাকা তিনি দিয়ে রেখেছেন। সেই ব্যাপারে আমরা পলিসি অ্যাডাপ্ট করে যদি তাঁর কাছে যাই, আমার পরিকল্পনার কথা জানাই এবং বলি যে ছবির সংখ্যা না বাড়ালে হলমালিকেরা আপনার দেওয়া ওই টাকা কাজে লাগাতে পারবে না। আপনি যখন এই এই পলিসি অ্যাপ্লাই করবেন, তখন সিনেমার সংখ্যা বাড়বে। সিনেমার সংখ্যা বাড়লে সবাই কাজ করতে পারবে। এতে রাষ্ট্র উপকৃত হবে। চলচ্চিত্রশিল্পের মানুষের আর হাত পাততে হবে না। মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে। সিনেমাহলে দর্শক যাচ্ছে না বলে সেখানকার মানুষেরাও তো বেকার হয়ে আছে। যখন সিনেমা চলবে, হলে মানুষজনও ভালো থাকবে। শিল্পী, ডাইরেক্টর প্রডিউসার ভালো থাকবে, টেকনিশিয়ানরা ভালো থাকবে। সরকারও এই অঙ্গন থেকে অনেক ট্যাক্স পাবে। এসব চিন্তা করে সমমনা সবাইকে নিয়ে প্যানেল করা। নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে একটা নিরাপদ চলচ্চিত্র অঙ্গন তৈরির পরিকল্পনা আপনারা করছেন। এই নিরাপদ করার ক্ষেত্রে কতটা চ্যালেঞ্জ বোধ করছেন?
আমি কিন্তু শুরুতেই বলেছি, শিল্পী সমিতির সঙ্গে অন্যান্য সমিতির অনৈক্য চলছে। আমরা যদি চলচ্চিত্রের অন্য সব সমিতিকে সঙ্গে নিয়ে মুভ করি এবং সবার সহযোগিতা নিয়ে যদি একটা সুন্দর কৌশলপত্র তৈরি করি, তাহলেই কিন্তু এটা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না।
চলচ্চিত্রের মানুষদের মূল কাজ তো চলচ্চিত্রের উন্নয়ন এবং সুনাম বাড়ানো, সিনেমার কাজ বৃদ্ধিতে অবদান রাখা। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির গুরুত্ব কতটুকু?
অনেকখানি গুরুত্ব। আমি বললাম না, আমাদেরকে মানুষ চেনে। আমাদের প্রস্তাবনা পেশ করার জন্য আমাদের শিল্পী সমিতির শিল্পীদের চেহারাগুলো দামি একটা ব্যাপার। এই কাজগুলো তো অন্যরা খুব একটা সহজে করতে পারবে না। আমরা শিল্পীরা চেষ্টা করব যখন, তখন চলচ্চিত্রের সামগ্রিক উন্নতি হবে। এতে শিল্পী, ডাইরেক্টর, প্রডিউসার, নৃত্যশিল্পী, ফাইটিং গ্রুপ এবং টেকনিশিয়ানরা বেনিফিটেড হব। বেনিফিট যাতে পুরো ইন্ডাস্ট্রি ভোগ করতে পারে, সেটা নিয়ে শিল্পী সমিতি অনেক ভূমিকা রাখতে পারে।
আপনি যাদের নিয়ে প্যানেল করেছেন তাদের সবার এজেন্ডা কি?
প্রথমত, শিল্পীতে শিল্পীতে যে বিভাজন তৈরি হয়ে আছে, সবার মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। আমরা ভাবছি, চলচ্চিত্রের ফাইটার এবং নাচের শিল্পী ও অন্য কলাকুশলীদের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করে আরও প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ নেওয়ার। আমাদের আসলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আছে। সার্বিকভাবে আমরা যদি সময়ের সঙ্গে না চলতে পারি, তাহলে পিছিয়ে পড়ব। এখন কিন্তু নতুন ছেলেমেয়েরা চলচ্চিত্রে আসতে চায় না। যখন দেখবে চলচ্চিত্রে একটা ভবিষ্যৎ আছে, তখন অনেকেই আসবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, শিল্পী ও শিল্পের গৌরব ফিরে এলে নতুনরা এসেও গর্ব বোধ করতে পারবে। আমরা তো গৌরবটাই হারাতে বসেছি। চলচ্চিত্রের সম্মান ও গৌরবের জায়গাটা ফিরিয়ে আনতে চাই।
কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্র শিল্পীদের নামের সঙ্গে ‘দুস্থ’ শব্দটা বারবার ব্যবহার হয়েছে...
শিল্পী ও কলাকুশলীদের সাহায্য দিয়ে ছবি তুলে, ফেসবুক লাইভ করে বাহবা কুড়াচ্ছে যারা, তাদের বলতে চাই—এসব তোমরা কোথা থেকে দিয়েছ? আমি নিজেও তো দিয়েছি। কখনো তো ছবি তুলে বলিনি। অন্যদের সাহায্য দেওয়াতে উৎসাহী করার নামে, চলচ্চিত্রশিল্পী ও তাদের পরিবারকে বাংলাদেশ ও পৃথিবীর মানুষের কাছে হেয় করা হয়েছে প্রতিনিয়ত। আমি যতদূর জানি, সামর্থ্যবান প্রায় প্রতিটা শিল্পী তাদের মতো করে দিয়েছে। এসবের অপবাদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ছবির কাজ বাড়াতে হবে। বিশ্বাস করেন কাজ বাড়লে চলচ্চিত্রে এই অস্থিরতাও থাকবে না। একজন শিল্পী, পরিচালক, টেকনিশিয়ান যখন নিয়মিত কাজ করবে, তার মধ্যে একটা জোশ থাকবে। আমাদের একজন জুনিয়র শিল্পী মনে করে, মাসে তাদের ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তাকে সাহায্য দিয়ে কত দিন আপনি বাঁচিয়ে রাখবেন। কাজের ব্যবস্থা করে দিলে তো সে নিজেই প্রতিদিন রোজগার করবে। সংসার চালাতে পারবে, ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলতে পারবে। সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারবে। এটা আমরা অবশ্যই করব।
এখনকার শিল্পী সমিতির নির্বাচনে যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখা যায়। মনে হয়, ‘পদ’ হারালে সব শেষ। পদের জন্য শিল্পীদের এত আকাঙ্ক্ষা কি আগে ছিল?
এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকে। শিল্পী সমিতির ভাবমূর্তি অনেক আগে নষ্ট হয়ে গেছে। ৩৩ বছর আগে আমি যখন সেক্রেটারি ছিলাম, তখন সংবিধানে লেখা ছিল, ১০টি ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করলে শিল্পী সমিতির সদস্য পদ লাভ করা যাবে। পরে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, ভোটের কথা চিন্তা করে ছবির সংখ্যা ৫টি করে দিয়েছেন, এরপর ৩টি। এটা করেছে স্বার্থ হাসিলের জন্য। গুটিকয় লোক তো মনে করেন, সমিতির পদে না থাকলে তাঁদের দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় নেই।