ভারতের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণের পর মমতাজকে নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। অভিযোগের তির মমতাজের দিকে তাক করে সবাই বলছেন, একটি ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই ডিগ্রি গ্রহণ করেছেন তিনি। এটি নিয়ে কথা বললেন মমতাজ। এসব নিয়ে সম্প্রতি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় তাঁর
এই সম্মাননার আমন্ত্রণ আপনি কীভাবে পেলেন?
বছরখানেক আগে কর্তৃপক্ষ আমাকে ই-মেইলে জানিয়েছিল। তারা বলেছিল, আমাকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিতে চায়। তখন আবার দেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে। বাইরের দেশ থেকে এমন একটি খবর শুনে আমি খুশি হলাম। তারপর আমার লোকজন দিয়ে খবরাখবর নিলাম। যতটা জানতে পারি, আমি লোকগানের সঙ্গে এত বছর ধরে আছি, বাউলদের নিয়ে কাজ করছি, সামাজিক নানা কর্মকাণ্ডেও নিজেকে যুক্ত রেখেছি বলেই তারা আমাকে বেছে নিয়েছে। করোনা পরিস্থিতি একটু উন্নতি হতেই মাস তিনেক আগে তামিলনাড়ুর ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার যোগাযোগ করে। তারা জানায়, একটা দিনক্ষণ ঠিক করেছে, চাইলে আমি এখন অংশ নিতে পারি। এ নিয়ে আমি কলকাতায় আমার পরিচিত বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে জানিয়েছে, এর আগে এই সম্মাননা বাংলাদেশের আরও একজনকে দেওয়া হয়েছিল। এবার যাঁদের সম্মাননা দিয়েছে, তাঁদের মধ্যে ওই দেশের সাবেক আইজিপি যেমন আছেন, তেমনি বিচারপতি, চ্যানেলের মালিক, তামিলনাড়ুর ধর্মগুরুও ছিলেন। ১০ জন বিশেষ ডিগ্রিধারী লোক ছিলেন। আমাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়েছে। পুরস্কার গ্রহণের পর সবার অনুরোধে গান শোনাতে হয়। আমি ‘না জানি কোন অপরাধে’ গানটি গেয়ে শুনিয়েছি। শুনে সবাই মুগ্ধ হয়েছেন।
তারা বাংলা ভাষা জানে না, সুরটাই নিশ্চয়ই তাঁদের আকৃষ্ট করেছে?
কিছু লোক বাংলা বোঝে, কিন্তু বেশির ভাগই বোঝে না। সুরটা ওদের বেশি আকৃষ্ট করেছে। তারপরও ওরা যে আনন্দ প্রকাশ করেছে, মনে হয়েছে বাংলাদেশের কোনো মঞ্চে গান গেয়েছি। ভীষণ ভালো লেগেছে। গানের পর অন্য অতিথিরাও নিজে থেকে আমার সঙ্গে পরিচিত হলেন। ওখানে গিয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, তারা যা করেছে, যেভাবে করেছে, সেটা মিথ্যা নয়। আমি অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি।
আপনার সম্মানসূচক এ ডিগ্রি অর্জনের খবর প্রচারের পরই ওই বিশ্ববিদ্যালয়টির অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তামিলনাড়ুর ওই বিশ্ববিদ্যালয় নাকি ভারতীয় সরকারের নথিতেই নেই?
এই বিষয়ে আমার গভীরভাবে জানা নেই। ওই দেশের ডিটেইলস আমার জানার কথাও না। যতটা পেরেছি আমার লোকজন দিয়ে খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, সবই ঠিকঠাক। আমার দেশ হলে হয়তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর নিতে পারতাম। তবে আমার কাছে বিষয়টি এই জন্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে, ওখানকার গণ্যমান্য যাঁরা উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই না জেনে সেখানে যাননি। আমি না হয় অনেক কিছু না জেনে গেছি। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা না জেনে আসার মানুষ নন। এই মানুষগুলো যেহেতু গিয়েছিলেন, তাই ধরে নিতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়টি ভুয়া নয়।
যত দূর জানি, অ্যালবাম প্রকাশে রেকর্ড করে ২০০৫ সালে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আপনার নাম এসেছিল। অথচ লোকগানে আপনার যে অর্জন, আপনার দেশ আপনাকে এ রকম একটি সম্মাননা দেয়নি বলে কোনো আক্ষেপ আছে?
এসব নিয়ে সত্যি বলতে আমার কোনো আক্ষেপ নাই। জীবনে আমি যখন যা পাই, অতটুকুকে আমি আলহামদুলিল্লাহ বলেছি। আমি মনে করি, যা পেয়েছি, সেটাই আমার ভাগ্যে ছিল। কিছু পাওয়ার জন্য আমি কাজ করি না। কেউ যদি আমাকে সম্মান দেয়, তা মাথায় মুকুটের মতো গ্রহণ করি। এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করেছি, নিজের চিন্তাভাবনা থেকেই করেছি।
কোন কাজের কথা বলছেন?
এই যে দুটো হাসপাতালসহ আমার এলাকায় যা কিছু করেছি, কাউকে কিন্তু দেখে করিনি। এসব যে করতে হবে, আমাকে কেউ তা শিখিয়েও দেয়নি। কখনোই কোনো কিছু পাওয়ার আশায়ও করিনি। আমি সরকারের তিনবারের এমপি। কেউ বলতে পারবে না, আমি আমার হাসপাতালে সরকারি কোনো সুবিধা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। চাইলে নিতে পারতাম। সরকারের এমন কোনো মন্ত্রী-এমপি নাই, যে মমতাজের কাছে আসে না। তাঁদের কাছ থেকে প্রায়ই অনুরোধ আসে, একটা প্রোগ্রাম করে দাও বা দেন আপা। সবার সঙ্গে এত ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আমি নিজের স্বার্থে কোনো সুবিধা নিইনি। আমার বিরোধী যাঁরা, তারাও আমার সম্পর্কে কোনো দুর্নীতির কথা বলতে পারবে না। আমি বাউলদের মিউজিয়াম করছি, এটাও আমার নিজের তাগিদ থেকে।
প্রত্যাশা ছাড়া যখন কিছু পান, কেমন লাগে?
মহাখুশি লাগে। কে কী বলল না-বলল, সেসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমাদের দেশে তো কেউ কাউকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার নেই। তাই নিন্দুকের কথা আমি মাথায় রাখি না। যখন সম্মান পাই, তখন ওটাকে সামনের দিকে আরও ভালো কাজ করার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যাই।
আপনি একজন সংগীতশিল্পীই শুধু নন, একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও। আপনার মুখে যখন শুনতে হয় যে দেশে এগিয়ে নেওয়ার লোক কম, তখন সাধারণ মানুষ হতাশ হবেন না?
(হাসি) এটা আসলে আমাদের জাতিগত চরিত্র। এটা নিয়ে অনেক নাটক, গান ও সিনেমা হয়েছে। এই দেশে কেউ যদি ওপরে উঠে যায়, তাঁর পা ধরে নিচে নামানোর চেষ্টা করি আমরা। বাঙালি বাস করছেন পৃথিবীতে এমন দেশ খুব কম, যেখানে আমি গান নিয়ে যাইনি। সেখানেও দেখেছি, একজন আরেকজনের সহযোগী। কেউ একটু ভালো করলে, বাকিরা অনেক উৎসাহ দেয়। তবে আমার বিশ্বাস, আমাদেরও উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দেওয়ার অভ্যাস হয়ে যাবে।
লোকে যখন বলছিল ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আপনাকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, খারাপ লাগেনি?
খুব বেশি খারাপ লাগেনি। আমি জানতাম, এই অর্জনের পর একটা গ্রুপ আমাকে নিয়ে নানা কথা বলবে। এই দেশের কারও কারও কাছে আমার নেতিবাচক দিকটা হচ্ছে, আমি আওয়ামী লীগের এমপি। এটা আমার অনেক বড় একটা দোষ। যারা আগে আমার গান শুনত, এমপি হওয়ার পর বলে, আপনার গান এখন আর ভালো লাগে না। তো একটা গ্রুপ যে উঠেপড়ে লাগবে, এটা অনুমেয় ছিল। জানতাম, তারা বলবে, অযোগ্য লোককে সম্মান দিয়েছে। এটা নিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুতি ছিল।
আপনি এই মুহূর্তে কী নিয়ে ব্যস্ত? ঈদে যে গানের অনুষ্ঠান করেন, সেটা করবেন? নতুন গান করছেন?
যদি সুস্থ থাকি বাংলাভিশনের ঈদের সরাসরি গানের অনুষ্ঠানে গাইব। দুটি নতুন ছবির কাজ করেছি। একটি মীর সাব্বিরের ‘রাতজাগা ফুল’ এবং অন্যটি হাসিবুর রেজা কল্লোলের ‘বন্ধু’। এ ছাড়া হাসান মতিউর রহমানের কথা, নাজির মাহমুদের সুর এবং মুশফিক লিটুর সংগীতায়োজনে দুটি নতুন গানে কণ্ঠ দিয়েছি।
করোনা মহামারির এই সময়ে লকডাউনের মধ্যে সরকারি দায়িত্ব কীভাবে পালন করছেন? বাড়ি থেকে বের হতে হচ্ছে?
আমার দলের যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলছি। ফোনে এলাকার খবরাখবর নিচ্ছি। মানুষ যাতে লকডাউন মানে এবং অন্য কোনো কষ্ট যাতে না হয়, সেটাও দেখছি।