অভিনেতা আবদুল কাদেরের অভিনয়জীবনের দীর্ঘদিনের সহযাত্রী নাট্যজন ও সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর। পর্দায় এবং পর্দার পেছনে তাঁদের রয়েছে বহু স্মৃতি। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুল কাদের। প্রয়াত এই অভিনয়শিল্পীকে নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন আসাদুজ্জামান নূর।
একে একে সংস্কৃতি অঙ্গনের অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে যাচ্ছেন। আবদুল কাদেরের চলে যাওয়ায় কতটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে?
কাদের যখন ভারতে চিকিৎসার জন্য যায়, তখনো ধারণা করিনি সে এত অসুস্থ। শুনেছি ব্যাক পেইন। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে এত অসুস্থ হয়ে পড়ছিল ভাবতেও পারিনি। অসুস্থতা ধরা পড়ার পর এত দ্রুত চলে যাবে, সেটাও ভাবতে পারিনি। অনেকে অনেক দিন ধরে অসুস্থ থাকেন, রোগে ভোগেন, তারপর একদিন চলে যান। এটা ঠিক, একদিন না একদিন সবাইকে যেতেই হয়, তাই মানসিক প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু কাদেরের ব্যাপারে আমাদের কারোরই কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ভেলোরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও সে আমার সঙ্গে ভিডিওতে কথা বলেছিল। ঢাকায় এসে হাসপাতালে ভর্তির পরও কথা বলেছে। হঠাৎ করে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। কাদেরের অসুস্থতায় কদিন ধরে আমি, রামেন্দুদা (রামেন্দু মজুমদার), ফেরদৌসী আপা (ফেরদৌসী মজুমদার)—কারওরই মন ভালো না। থিয়েটারের সঙ্গে সে দীর্ঘদিন ধরে আছে। নিয়মিত দেখা না হলেও আমাদের প্রায়ই ফোনে কথা হতো। অসাধারণ একজন মানুষ সে। যেকোনো মানুষ চলে গেলেই একটা শূন্যতা তৈরি হয়। কিন্তু কিছু মানুষের চলে যাওয়া মানতে খুব কষ্ট হয়। এ বছর আমরা বহু মানুষকে হারিয়েছি। এই অবস্থা যে আরও কত দিন চলতে থাকবে!
আপনারা একসঙ্গে অনেক নাটকে অভিনয় করেছেন। পর্দার পেছনেও কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে নিশ্চয় আপনার অনেক স্মৃতি। সেই স্মৃতির ভান্ডার থেকে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে এমন কোনো স্মৃতির কথা যদি বলতেন।
শুধু টেলিভিশন নাটকে নয়, কাদেরের সঙ্গে আমাদের অনেকেরই যোগাযোগ সেই মঞ্চনাটকের শুরু থেকে, যখন মাত্র কয়েকটি নাটকের দল। কাদের তখন থেকেই খুবই সক্রিয় ছিল। সত্তরের দশকের শুরুতে গ্রুপ থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল হয়েছিল। ওই বছরে আমি, বাচ্চু (নাসির উদ্দীন ইউসুফ), আর কাদের (আবদুল কাদের) ছিলাম একদম গায়ে খাটা লোক। কাদের শুধু অভিনয়শিল্পী হিসেবে নয়, সাংগঠনিকভাবেও বেশ দক্ষ ছিল। একটা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করত বলেই হয়তো অনেক সময় আমাদের সঙ্গে আন্দোলন-সংগ্রামসহ নানা অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে আসতে পারত না, বিধিনিষেধও ছিল। কিন্তু সব সময় সে আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। অনুষ্ঠান চলাকালে, মিলনায়তনের সামনে না বসে একদম পেছনের সারিতে থাকত। সব সময় আমাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গেই ছিল। সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত ছিল। যেখানেই যেত, সবাইকে নিয়ে হইচই করে মাতিয়ে রাখত।
আপনাদের সবচেয়ে আলোচিত নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’–এর শুটিংয়ের সময়ের কোনো স্মৃতি মনে পড়ছে?
আলাদা করে সেভাবে কিছু মনে নাই। তবে আমরা একসঙ্গেই থাকতাম। এমনিতে সহ–অভিনেতা হিসেবে সে খুব হেল্পফুল ছিল। সে বলত, নূর ভাই এভাবে করলে কেমন হয়, ওভাবে করলে কেমন হয়? শুধু আমাদের না, সে হুমায়ূনকেও বলত, ‘হুমায়ূন ভাই, এই দৃশ্যটা এভাবে করি?’ আমরা যেমন হুমায়ূনকে কিছু বলতাম না, কাদের কিন্তু বলে ফেলত। হুমায়ূনও কিন্তু খুব সহজভাবে তার কথা শুনত।
অভিনয়শিল্পী ও মানুষ আবদুল কাদেরকে নিয়ে আলাদা করে আপনার মূল্যায়ন শুনতে চাই।
জোর গলায় বলতে চাই, কাদেরের সমকক্ষ মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো দিন কারও বিরুদ্ধে তাঁকে অভিযোগ করতে শুনিনি। এটা করতে পারলাম, এটা তো পেলাম না বলেও আক্ষেপ ছিল না। মানুষকে সব সময় একটা আনন্দময় পরিবেশে রাখার চেষ্টা করত। নিজের জীবনেও সে অনেক স্যাক্রিফাইস করেছে। স্বামী হিসেবে যেমন অসাধারণ, তেমনি বাবা হিসেবেও। আর বন্ধু হিসেবে তো অতুলনীয়। সবাইকে যেহেতু আনন্দময় পরিবেশে রাখতে ভালোবাসত, নাটকেও ওই ধরনের চরিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল বেশি।
সমসাময়িক অনেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সংস্কৃতি অঙ্গনের সবাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে। এটা আপনাকে কতটা নাড়া দিচ্ছে?
স্বাধীনতার পর শিল্প–সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্ব দিতে শুরু করেছিল, সেই মানুষদের অনেকেই এখন প্রবীণ নাগরিক। এখন যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা সবাই কাছাকাছি বয়সের। এই সংখ্যাটা এখন অনেক বেশি। এটা প্রকৃতির নিয়মেই ঘটছে, নাকি করোনার কারণে হচ্ছে... একেকজন একেক রকমভাবে ভাবছে।
আর কদিন পরই নতুন বছর। সামনের বছর নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
কদিন আগে ফেরদৌসী আপার (ফেরদৌসী মজুমদার) সঙ্গে আবদুল কাদেরের অসুস্থতা নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখন আপা আর্তনাদের মতো করেই বলছিলেন, নূর, এই বছরটা কবে যে শেষ হবে? আমার এখন কেবল মনে হচ্ছে, এই বছরটা কবে শেষ হবে? আগামী বছরের কথা ভাবতেই পারছি না। তারপরও আমরা আশাবাদী থাকি। সামনে ভালো সময় আসবে। বিপদ কেটে যাবে। মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আবার বাংলাদেশের মানুষ প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে। পৃথিবীর মানুষও তাই। আমরা তো এখন আর পৃথিবীর মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। করোনার টিকা এসেছে। টিকা যদি দ্রুত আমাদের দেশে আসে। টিকার ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারিভাবে সব ধরনের উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আমরা আশা করি, আবার আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব।
আপনি তো করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন কেমন আছেন?
২২ ডিসেম্বর আমার কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো হয়েছে। ফল নেগেটিভ এসেছে। তবে শারীরিক দুর্বলতা আছে। খাবারের স্বাদ কম পাচ্ছি। অনিদ্রা একটু ভোগাচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, এ রকমটা হতেই পারে, চিন্তার কোনো কারণ নেই।