গত ঈদুল ফিতরে ৩১টি নাটকে দেখা গেছে অভিনেতা মুকিত জাকারিয়াকে। নতুন দুটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও ছিলেন তিনি। কাজ করছেন দুটি ধারাবাহিকে। এত কর্মব্যস্ত দিনের দেখা তিনি সহজে পাননি। গতকাল দুপুরে উত্তরায় তিনি ছিলেন ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’ নাটকের শুটিংয়ে। ফাঁকে জীবনের নানা গোপন বেদনার কথা জানালেন এই অভিনেতা।
‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’-এর প্রতিক্রিয়া কেমন?
এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি নাটক। এমন নাটকের পার্ট হওয়াটা ভীষণ আনন্দের। আমি একই সময়ে আরেকটি জনপ্রিয় নাটক ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’–এও কাজ করছি।
অত্যন্ত জনপ্রিয় কী হিসেবে?
‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নাটকের ইউটিউব ভিউ এরই মধ্যে ২৭ কোটি হয়েছে। আর ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’-এর ভিউ ৪০ কোটির কাছাকাছি।
ভিউ বেশি তাই জনপ্রিয় বলছেন?
না, একদমই তা না। জনপ্রিয়তা হচ্ছে, একটা চরিত্র নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা। সংলাপ মানুষের মুখে মুখে থাকা। গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম, আমাকে নানা নামে ডাকাডাকি করছিল। এর মধ্যে কেউ কেউ বলছিল, এই যে জাকির ভাই, আপনি কি হাবু ভাইয়ের টাকাটা দেবেন না! তরুণ-তরুণীরা যখন এভাবে ডাকে, তখন জনপ্রিয়তা শব্দকে অমূলক বলা যাবে না। কিছুদিন আগে তো নরসিংদীর ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক মেয়ে আমাকে ধমকও দিয়েছে, কেন আমি হাবুর টাকা দিচ্ছি না!
রাস্তায় বের হলে আর কী কী নামে ডাকে?
একেক সময় একেক নামে। কিছুদিন ধরে বলছে, ‘ভাই মাস্ক’, ‘বাংলালিংক ভাই’, ‘মিসড কল মফিজ’।
মানুষের কাছে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, এটাও উপভোগ করছেন?
আমাকে ১১ বছর আগে এই চরিত্রে দাঁড় করিয়েছেন আমার গুরু মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। তাঁর একটা বিজ্ঞাপনচিত্র ছিল, সেখানে আমি ‘মিসড কল মফিজ’। এরপর তো ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, হাবিব ওয়াহিদ থেকে শুরু করে সবাই ‘মিসড কল মফিজ’ নামেই ডাকত। আমার কিন্তু ভালোই লাগে।
ঈদুল আজহায় আপনার যতগুলো নাটক প্রচারিত হয়েছে, সেটা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। কেউ কেউ বলছেন, আপনি অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছেন।
সত্যিই তাই। কয়েক মাস আগেও আমি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। এখন সরে এসেছি। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ আমাকে ব্যস্ত রাখত। সোলসের গানের মতো বলতে হয়, ‘ব্যস্ততা আমাকে দেয় না অবসর’। তাই কোনো কাজ করতে পারতাম না।
কাজ করতে না পারায় কষ্ট হতো?
প্রতি নিশ্বাসে আমি কষ্ট পেয়েছি। আমার তথাকথিত কয়েকজন বস আমাকে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, জনপ্রিয় হলে আমি তাঁদের ছেড়ে চলে যাব।
আপনার অভিনয়ের শক্তি কী?
জেদ। জেদ থেকেই অভিনয় করি। জেদ শব্দটা শুনলেই আমার চোখের সামনে ৫-৭ জন মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। যাঁরা কখনোই চাননি, আমি অভিনয় করি, পরিচিতি পাই। তাঁরা আমাকে একসময় উপহাস করতেন, তিরস্কার করতেন। এমনকি আমার উচ্চতা আর চেহারা নিয়ে বাজে মন্তব্য করতেন। এমনকি আমার অনেক বন্ধুবান্ধবও এমন করত।
কেন এমন করত?
আমার চেহারা ভালো না। আমি নাকি দেখতে হুতুমপ্যাঁচার মতো। আমার শত্রুরা যে আমাকে উপহাস করেছে, এটাই ছিল শক্তি। আমি আরও ক্ষিপ্র হয়েছি, কাজে মনোযোগী হয়েছি। কাজের মাধ্যমে বন্ধুবান্ধব ও তথাকথিত বসদের জবাব দিয়েছি।
আপনি পরিচিতি পান। সবার ভালোবাসা পান, এটা যাঁরা চান না, তাঁরা আপনার বন্ধু হন কীভাবে?
তাঁরা আসলে মুখোশধারী। পরে সেটা বুঝতে পেরেছি। কারণ, তাঁরা একধরনের নোংরা মন নিয়ে চলাফেরা করেছেন। যেখানে আমাকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার কথা, সেখানে আমাকে টেনে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই করেছেন।
মুখোশধারীদের কথা মনে হলে কী করতেন?
অনেক কষ্ট হতো। বাসায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতাম আর বলতাম, আমার অপরাধটা কী! কাপড়চোপড়, বাচনভঙ্গি, চুলের স্টাইল নিয়ে তাঁরা কটাক্ষ করতেন। যাঁরা আমাকে উপহাস করতেন, তাঁরাই এখন ওয়েস্টিন, সোনারগাঁও হোটেলে ডিনারের দাওয়াত দেন। তাঁদের বাড়ির বিশেষ অনুষ্ঠানে সপরিবার আমাকে দাওয়াত করেন। আমি যাই না। আমার সঙ্গে আত্মীয়স্বজনও খুব বাজে আচরণ করতেন। আত্মীয়রা আমাকে আর আমার পরিবারকে কখনো দাওয়াত পর্যন্ত দিত না। পরিচিতি পাওয়ার পর সব বদলে যেতে থাকে।
তার মানে অভিনয়ে আসার আগেও এমনটা হতো?
স্কুলে থাকতে এসবের মুখোমুখি হই। আমি তখন চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলে পড়তাম, সিনিয়র ভাইদের সঙ্গে মিশতাম। জুনিয়র ছেলে–মেয়েরা আমাকে কেন জানি সালাম দিত, ভালোবাসত। এসব দেখে সিনিয়ররা খেপে যেত, উপহাস করত।
অভিনয়ে এসে কখনো পলিটিকসের শিকার হয়েছিলেন?
হয়েছি মানে, একদম প্রথম দিন থেকে পলিটিকসের শিকার। কত কী যে হয়েছে আমার সঙ্গে...। খুবই নোংরা পলিটিকস।
কেমন পলিটিকস?
খুবই নোংরা। আমি যেন নাটকে কাজ করতে না পারি, সেই চেষ্টা হতো সবচেয়ে বেশি। কেউ কেউ তো পরিচালককে জিজ্ঞেস করত, নাটকে কে কে আছে? মুকিত জাকারিয়া আছে শুনলে বাদ দিয়ে দেওয়ার কথাও বলত, যা আমি পরে জেনেছি। এমনও হয়েছে, সকাল থেকে শুটিং করে বিশ্রাম নিচ্ছি, তখন সেটে একজন অভিনয়শিল্পী এলেন। আমি শুয়ে আছি, তিনি মনে করেছেন আমি ঘুমিয়ে গেছি। ওই অভিনয়শিল্পী পরিচালককে বলছিলেন, মুকিতের অত ডায়ালগ রাখার দরকার নেই। পরে ছাদে গিয়ে যখন শুটিং করছি, তখন তাঁর নয়টা সংলাপ, আমার মাত্র একটা!
এই মানুষগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই আপনার দেখা হয়। কেমন আচরণ করেন?
আমি করপোরেট কালচার থেকে এসেছি। স্বভাবতই সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়েছেন, পরিবার থেকেও তেমনটা শিখেছি। কখনো মানুষকে উপহাস করে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখাইনি। যাঁরা আমার সঙ্গে এমনটা করেছেন, কতটুকু সফল হবেন জানি না। তবে আমার বিশ্বাস, দীর্ঘযাত্রায় তাঁরা কখনোই টিকবেন না। আর একদিন না একদিন এসব আচরণ তাঁকে পীড়া দেবেই।
বিনোদন অঙ্গনে কাজ করতে এসে পরিবারের সহযোগিতা পান?
আমার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট করে। ঈদের আগে ১ মাস ১৭ দিন কাজ করেছি। কোন নাটকে আমার কী কস্টিউম, সেটাও আমার স্ত্রী ঠিক করে দিয়েছে। আমার জন্য সবচেয়ে বড় সাপোর্ট আমার স্ত্রী। শুটিং স্পট থেকে আমি যদি রাত চারটায়ও বলি, ক্ষুধা লেগেছে। বলেছে, কী খাবে। আমি বললাম, তেল ছাড়া পরোটা আর খাসির মাংস। এক ঘণ্টা পর বাসায় গিয়ে দেখি খাসির মাংসের গরম ধোঁয়া উঠছে। এটা আমার জন্য কত বড় সাপোর্ট, বলে বোঝাতে পারব না। আম্মার বয়স ৮২, তিনি আমার সঙ্গে থাকেন। বাবা ১৫ বছর আগে মারা গেছেন। আমার মেয়ের বয়স ৭ বছর ৪ মাস। বাবা আমার কাজ দেখে যেতে পারেননি। তবে বাকি সবাই ভীষণ খুশি।
আপনি তো মঞ্চ থেকে আসেননি, অভিনয়ে এত ভালো করছেন কীভাবে?
আজ আমার যা কিছু অর্জন, এ জন্য নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করব। তিনি আমাকে অনেক সম্মান দিয়েছেন। সরয়ার ভাই প্রথম দিনই আমাকে বলেছিলেন, আপনার সামনে থাকা ক্যামেরার কথা ভুলে যান। এটাকে উপেক্ষা করে আপনি ডায়ালগ থ্রো করবেন। এটাই মেনে আমি চলেছি। আমি প্রচুর সিনেমা দেখি, দেশ-বিদেশের নাটক দেখি। বড় বড় অভিনয়শিল্পীর অভিনয়কৌশল দেখি। সেটে অন্য অভিনয়শিল্পীরাও কীভাবে কী করছেন, তা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি।