বেশ কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন অভিনয়শিল্পী ও চিত্রকর বিপাশা হায়াত। এই সময়ে তিনি ছবি আঁকা, লেখালেখি ও কবিতার ক্লাস করেছেন। নিউইয়র্কে একটি একক চিত্র প্রদর্শনীও হয়েছে তাঁর। দেশের বাইরে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনীসহ নানা প্রসঙ্গে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিপাশা।
নিউইয়র্কে প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে জানতে চাই।
নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে প্রিমাভেরা গ্যালারি অব বিডি আর্ট নামের একটা অসাধারণ গ্যালারি হয়েছে, শামীম শাহেদ করেছে এটি। শামীম বেশ কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কে আছে এবং সে আমাদের খুব কাছের মানুষ। গত মাসে হঠাৎ সে ফোনে বলল, ‘আপা, জ্যাকসন হাইটসে আমি একটা কোজি গ্যালারি করছি। আপনার কাজ দিয়ে যদি এই গ্যালারির যাত্রা শুরু হয়, আপনার আপত্তি আছে?’ প্রস্তাবটি শুনে আমি অত্যন্ত বিস্মিত ও আনন্দিত হই। এটা একটা অসাধারণ পদক্ষেপ। আমি তাৎক্ষণিকভাবে রাজি হয়েছি।
প্রদর্শনীতে আপনার কতগুলো চিত্রকর্ম রয়েছে?
ছোট-বড় মিলিয়ে ২৪টি পেইন্টিং।
বিদেশে নিজের চিত্রকর্মের প্রদর্শনীর ব্যাপারটা কেমন লাগছে?
দেশের বাইরে পা দেওয়া মানে শিল্পী আর ব্যক্তি থাকে না। সে রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই দায়িত্ব নিয়েই কাজ করা প্রয়োজন। বিদেশের প্রদর্শনী এক্সপোজার দেয়, আত্মবিশ্বাসী করে শিল্পীকে। যেখান থেকে নিজেকে সমৃদ্ধ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ তৈরি হয়। যেকোনো মাধ্যমের শিল্পী যখন এগিয়ে যান, তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্রও এগিয়ে যায়। আর পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে শিল্পকর্ম বা শিল্পীর অবস্থানও স্পষ্ট হয়।
যেকোনো চিত্রকর্ম সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন বিষয়টা আপনাকে বেশি উৎসাহ জোগায়?
সমাজব্যবস্থা, প্রেম, স্বপ্ন বা বেদনা, আমার রচিত নাটকের বিষয়বস্তু। আর যে জগৎ দেখা যায় না, তার স্বরূপ আবিষ্কার করতে আমি পছন্দ করি আমার শিল্পকর্মের ভেতরে। পেইন্টিংয়ের টার্মে আমার কাজগুলোকে আমি কনসেপচুয়াল হিসেবে বিশেষায়িত করি।
এখনকার টেলিভিশন নাটক বা ওয়েব প্ল্যাটফর্মের যে নাটক হয়, তা কি দেখেন? কেমন লাগে?
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এখন সত্য, যেমন সত্য ইন্টারনেট, ওয়াই–ফাই বা যেকোনো সোশ্যাল মিডিয়া—জাপানি আর্টিস্ট হকুসাইয়ের বিখ্যাত পেইন্টিং ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ অব কানাগাওয়া’-এর মতো। বিশাল ঢেউ আসছে, এসেছে এবং পাড়ে আছড়ে পড়বেই। কিন্তু সেই ঢেউ যেন ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে না আনে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বেশির ভাগ কাজ দেখে আমার মনে হয় ট্রিটমেন্ট–সর্বস্ব। সুন্দর কনসেপ্ট বা আইডিয়াও চাপা পড়ে যাচ্ছে গল্প, ন্যারেটিভ, স্ক্রিনপ্লে, চরিত্র বা ভালো সংলাপের অভাবে। তবে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে যাঁরা নিজেদের তৈরি করছেন, তাঁদের কাজ ভালো হতে বাধ্য।
প্রদর্শনী দেখতে আসা শিল্পপ্রেমীদের প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ হয়েছিল?
আমি নিউইয়র্কে নেই, তাই দর্শক প্রতিক্রিয়া জানতে পারছি না। তবে শামীম শাহেদের কাছ থেকে শুনেছি, কখনো সে দর্শকের সঙ্গে আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দেয়। যাঁরা আমার ছবি দেখতে আসছেন, তাঁদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই কাজগুলো আমার ‘সাবকনশাস টেক্সট’ সিরিজের। অন্য কথায় যাকে বলা যায় ‘অ্যাসেমিক রাইটিং’। এই লেখা কোনো স্পেসিফিক ভাষা নয়, ফলে কোনো অর্থ বহন করে না। এগুলো আমার অবচেতন মনের স্বগতোক্তি, যা নির্ধারণ করে আমাকে। নিজের ভেতরটাকে দেখার চেষ্টা বলা যায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, অভিনয়ের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সংলাপের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অভিনয়শিল্পীর জানা যেমন অবশ্যকর্তব্য, তেমনি একটি চরিত্র নির্মাণের জন্য সেই মানুষটির অবচেতন মন বিশ্লেষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে অভিনয়শিল্পীর পক্ষে সেই চরিত্রের অভিব্যক্তি বা আচরণ নিজের মধ্যে ধারণ করা অসম্ভব। অর্থাৎ মাধ্যম ভিন্ন হলেও বিষয় এক।
যত দূর জানি, আপনি লেখালেখিও করেন। ইদানীং কী লিখছেন?
আমি লেখক নই। আমার লেখালেখির শুরু প্রথম আলোর কারণে। এখন ছোটগল্প লেখার চেষ্টা করছি। তা ছাড়া ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু লেখা লিখেছি, ছন্দ ও অন্ত্যমিলের কারণে কেউ কেউ সেগুলোকে কবিতা বলে ফেলতে পারেন। আমি সেই ঔদ্ধত্য দেখাব না। এই সবই মনের তাগিদে উদ্দেশ্যহীন লেখা।
দেশ-বিদেশের দর্শকের মনে অভিনেত্রী বিপাশার অবস্থান। সেই আপনাকে অভিনয়ে না পেয়ে দর্শকের অভিমান রয়েছে। আপনি অভিনয়ে নেই কেন?
আমি অভিনয়কে ভালোবাসি। কিন্তু সমাজের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে। নাটক আমার কাছে পরিপূর্ণ এক শিল্প। সেখানে বাণিজ্য অবশ্যই থাকবে। কিন্তু একটা সময় মনে হয়েছে, বাণিজ্যই আসল, শিল্প নয়। অনেক বেশি কম্প্রোমাইজ করছে সবাই। তখন আমি সিরিয়াসলি ছবি আঁকতে শুরু করি। আর্ট প্র্যাকটিস কিন্তু শতভাগ সময় ডিমান্ড করে। এভাবেই দূরে সরে গেছি। আর এখন তো নতুনদের কাজ করার সময়। তাঁদের অনেকের অসাধারণ অভিনয় আমাকে মুগ্ধ করে। তবে দর্শকের অসীম ভালোবাসার কাছে আমি চিরঋণী এবং অবশ্যই আমি অভিনয় করব।
অভিনয় কমিয়ে দেওয়ার মতো সময় আপনার এসেছে এটা কিন্তু আপনার ভক্তরা বিশ্বাস করতে চান না।
হা হা হা, বয়স হচ্ছে, সেটা মানতে হবে। সেটাই সুন্দর।
এখন পরিচালক, অভিনয়শিল্পী অনেককে বলতে শুনি, দর্শকের চাহিদার বিষয়টি মাথায় রেখে গল্প তৈরি করেছি বা অভিনয় করেছি। দর্শকের চাহিদা মোতাবেক কাজ হবে, নাকি দর্শকের চাহিদা ও রুচি তৈরি করবেন নির্মাতারা?
আমরা বলি, আমরা ক্রিয়েটিভ ফিল্ডে কাজ করি। তাহলে আমাকে সমাজ দায়িত্ব দেয় নতুন কিছু ক্রিয়েট করার। আমি যদি সে কাজে ব্যর্থ হই তখন অন্য কেউ, যা একসময় ক্রিয়েট করে গেছেন সেখান থেকে ধার করে, কেবল পুনরাবৃত্তি করে। অর্থাৎ নিজেকে নিজেই অযোগ্য প্রমাণ করে। একজন সৃজনশীল মানুষকে অবশ্যই তাঁর সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের রুচিবোধের উত্তরণ ঘটাতে হবে তাঁর কাজের মাধ্যমে। সৃজনশীল মানুষ তো আলোকিত মানুষ। তিনি অন্যকে আলোকিত করবেন, সেটাই কাম্য।
দেশ–বিদেশের নাটক, সিরিজ নিশ্চয়ই দেখেন। টেলিভিশন নাটকে আমাদের অবস্থান কোথায় বলে মনে হয়?
আমার মনে হয় আমাদের সংস্কৃতিচর্চাকে আমরা অত্যন্ত জটিল করে তুলেছি। সহজ পথ হলো যার যা সৃষ্টি করতে ইচ্ছে হয়, সে বিষয়ে যতটুকু সম্ভব প্রশিক্ষণ নেওয়া। জ্ঞানের দুয়ার পৃথিবীজুড়ে এখন অবারিত। নিজেকে প্রস্তুত করে যে কেউ পৃথিবীজুড়ে বাজিমাত করতে পারে। যতক্ষণ আমরা নির্ধারিত জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন না করব, ততক্ষণ সীমাবদ্ধতা থাকবেই। তবে সময় নিশ্চয়ই পাল্টাবে। মানুষের ধারণা পাল্টাবে। আমরা আমাদের ইতিহাসভিত্তিক অনেক কাজ নিশ্চয়ই পাব। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম অসম্ভবকে সম্ভব করার সুযোগ। স্বাধীনতাযুদ্ধ, একুশ, বুদ্ধিজীবী হত্যা বা আমাদের আদি উৎস বা প্রাচীন ইতিহাস বা সমসাময়িক অনেক ঘটনা কনটেন্ট হতে পারে। এ বিষয়গুলোকে ডিটেইলে দেখানোর অনেক সুযোগ আছে। সেগুলো দিয়ে সহজেই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের দর্শকের কাছে বাংলাদেশকে তুলে ধরা সম্ভব। আমরা কি সেটা ভাবছি? সেই প্রস্তুতি কি আমাদের আছে? একাত্তরের একটি নিখুঁত যুদ্ধের দৃশ্য কি আমরা এখন পর্যন্ত কোনো ওয়েব সিরিজে দেখতে পেয়েছি?
টেলিভিশন নাটকে আমাদের কি পরিচালক বা অভিনয়শিল্পীর সংকট নাকি সমস্যা অন্য জায়গায়?
মেধার সংকট একদমই নেই। আমাদের বেশির ভাগ অভিনেতা বা পরিচালক অত্যন্ত মেধাবী। আমি আশ্চর্য হই এবং আশান্বিত বোধ করি তাঁদের কাজ দেখে। সংকট প্রস্তুতির।
বিপাশা হায়াত ও তৌকীর আহমেদ দুজনেই সংস্কৃতি অঙ্গনের দারুণ একটা অবস্থানে রয়েছেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে দুজনের চিন্তাভাবনা কী? তাদেরই–বা আগ্রহ কোন দিকে?
আমি এবং তৌকীর দুজনই চাই আমাদের সন্তানেরা তাদের পছন্দমতো বিষয় বেছে নেবে, যা তাদের আনন্দ দেবে। তাদের বিভিন্ন আর্ট ফর্মের প্রতি আগ্রহ দেখি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কোন বিষয়ে পড়বে বা কোন ক্ষেত্রে কাজ করবে, সেটা সময় বলে দেবে।
করোনা অনেককে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। আপনার মধ্যে কোনো নতুন ভাবনা উঁকি দিয়েছে?
এ সময়টাকে আমি ‘পাথর সময়’ আখ্যা দিয়েছি। এ নিয়ে বেশ কিছু ড্রয়িং বেইজড কাজ করছি। অনেকটা ডায়েরি লেখার মতো। পাথরের ভাষায় লেখা সে ডায়েরি।