>
আজ রাত নয়টায় এবিসি রেডিও ৮৯.২-এ শুনবেন ‘শুভেন্দু মাইতি ও কিছু কথা’। ভারতের এই বিশিষ্ট লোকসংগীত গবেষক ও শিল্পী ঢাকায় এসেছেন কৃষ্টি ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে। শুভেন্দু মাইতির সঙ্গেই হলো কিছু কথা।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে নতুন বাংলা গানের ধারা তৈরি করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের আপনি নিজে নিয়ে গেছেন এইচএমভিতে। রেকর্ড করিয়েছেন গান। সে সময়টার কথা একটু বলবেন?
’৮০–৮২ সালের দিকে লক্ষ করলাম, বাংলা গানের খরা চলছে। তখন থেকেই নতুন গান খুঁজে বেড়াই। এরপর একদিন কেউ একজন বলল, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে গিটার হাতে একজন গাইছিল। নাম সুমন। পদবিটাও বলতে পারেনি। এরপর ছয় মাস আমি সুমনকে খুঁজে বেরিয়েছি। ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর ওর ঠিকানা জোগাড় করি। ও একটা ধুতি–পাঞ্জাবি পরা লোক দেখে অবাক হয়। আমি বলি, আপনার গান শুনতে এসেছি। সেদিন ছয় ঘণ্টা গান শুনলাম। সে–ই শুরু। আমার মনে হয়েছিল, এ গান বাঙালির কাছে পৌঁছানো দরকার। সুমনেরা নিজেদের যোগ্যতাতেই বড় হয়েছে। আমি শুধু অনুঘটকের কাজ করেছি। আমি ওদের এইচএমভিতে নিয়ে গেছি। বলেছি, আমি মার্কেট তৈরি করব। প্রোগ্রাম দেব। সেই যে একটা নতুন বাংলা গানের প্রবাহ এল—নচিকেতা, অঞ্জন, তপন, কাজি কামাল নাসের, লোপামুদ্রা, রাঘবেরা নিজেদের জায়গা করে নিল।
গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আপনি। তখন তো সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতা নিয়ে অনেক ধরনের সংকট দেখা দিয়েছিল। বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো লোকদের সঙ্গেও খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল...
ঋত্বিক ঘটককেও তো ওরা বের করে দিয়েছিল। আসলে একটা কথা ছুড়ে দেওয়া হতো, সংস্কৃতিকর্মীদের একটু রাজনীতিসচেতন হতে হবে। সে তো হতে হবেই। নইলে কাজ করবে কী করে? কথা যেটা বলা হতো না, তা হলো রাজনৈতিক কর্মীদেরও সংস্কৃতিসচেতন হতে হবে। একজন খুব ভালো মানুষ, কৃষকনেতা জয়ন্তদা আমাকে ঠাট্টার ছলে বলছিলেন, আমি তো তোমাদের কালচারটা বুঝি না শুভেন্দু, আমি অ্যাগ্রিকালচারটাই বুঝি। আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে বলেছিলাম, যদি অ্যাগ্রিকালচারই বোঝেন তাহলে ধান চাষ করতে যান, পাট চাষ করতে যান, কমিউনিস্ট পার্টি করতে এসেছেন কেন, যদি সংস্কৃতি না বোঝেন? ‘সংস্কৃতিটা বুঝি না’—এটা কোনো গর্বের উচ্চারণ নয়। ১৯৯৪ সালে আমাকেও পার্টি সদস্যপদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। তাতে কী হলো? দেশে সবাই জানে, আমি লোকটা বামপন্থী। কোনো পার্টির শংসাপত্র লাগে না আমার।
আপনি লালন আকাদেমি করেছেন। লালনকে বাঁচাবেন কী করে?
আমাদের দেশ থেকে ধানের বীজ হারিয়ে যাচ্ছে। হাইব্রিড ধানের চাষ হচ্ছে। শুধু ধান না, আমাদের দেশ থেকে গানের বীজও হারিয়ে যাচ্ছে। লোকসং্গীত আমাদের কাছে আটপৌড়ে মায়ের মতো। হলুদের দাগ লাগা, ঘরে কাচা শাড়ি পরা মা। ঘরে দামি তোয়ালে থাকলেও খাওযার পর মুখ মোছার জন্য মায়ের আঁচলের পেছনে আমরা দৌড়াতাম। তার এই আটপৌড়ে রূপটাকেই রক্ষা করতে হবে। মাকে জিনস পরিয়ে, টপ পরিয়ে, গায়ে বিদেশি সুগন্ধি লাগিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় বেঁচার জন্য, ওটা করা যাবে না। বীজ রক্ষা করতে হবে। আজ থেকে ৪০ বছর পর কেউ যদি কাজ করতে চায় লোকসংগীত নিয়ে, তার হাতে যদি আমরা হাইব্রিড বীজটা ধরিয়ে দিই, চারা বের হবে না। তাই গানের মূল বীজটাকে রক্ষা করতে হবে। এটা একটা নাগরিক দায়। এটা শিল্পীরা করতে পারবে না। এটার জন্য প্রযুক্তি লাগে, প্রতিষ্ঠান লাগে। আমি এ কারণেই লালন একাডেমি তৈরি করেছি। সেখানে ১৫ হাজান গান আমরা ডিজিটালাইজড করেছি। একেবারে মাঠে ময়দানে, মেলা থেকে সংগ্রহ করেছি। সারা পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে চাইলে আমরা তা পাঠিয়ে দিতে পারি।
আপনার চলার পথটা তাহলে কীভাবে নির্ধারণ করেন?
আমার দুই লাইনের একটা কবিতা শুনুন—
‘কেয়ার করি না কী বলল কটা ভনভনে নীল মাছি
আমি রণক্ষেত্রে আছি।’
রণক্ষেত্রে থাকলে আমাকে কে হারাবে?