>বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একসময়ের বরেণ্য অভিনেত্রী শবনম। দেড় দশকেরও বেশি সময় নতুন কোনো চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করেননি। তিনি চলচ্চিত্রে যুক্ত হয়েছিলেন ১৯৫৮ সালে। এরপর দেড় শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ অভিনয় করেছেন ‘আম্মাজান’ সিনেমায়। তেমন কোনো অনুষ্ঠানেও দেখা যায় না তাঁকে। হঠাৎ কখনো দেখা মিললে আবার ডুব দেন। এখন কীভাবে সময় কাটছে বরেণ্য এই অভিনয়শিল্পীর? গত রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কারণ বললেন।
চলচ্চিত্রশিল্পের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খবর রাখেন?
এটা কিসের ইন্ডাস্ট্রি! এটাকে কীভাবে ইন্ডাস্ট্রি বলি আমরা? ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে কিছু বলতে হয় বা লিখতে হলে তো আসবে এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, রহমান, এ জব্বার খান, শবনম, সুচন্দা, কবরী, ববিতা, রাজ্জাক, আলমগীর—প্রথম দিকে যাঁরা চলচ্চিত্রে এসেছিলেন, তাঁদের নাম নিতে হবে। এখন তো তাঁদের কেউ কোনো সম্মান করে না। কাকে আমার গল্প শোনাবেন! কী যে হচ্ছে, কিছুই বুঝছি না।
চলচ্চিত্রের কারও সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলেছেন?
না, আমি কিছু চাই না। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি। আমি জানি, এসব বলে কোনো লাভ হবে না। এই ইন্ডাস্ট্রির আসলে কিছুই হবে না। মাঝে এক শুক্রবার এফডিসির সামনে দিয়ে যাচ্ছি, গাড়ি ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সাউন্ডের রুমের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছি। এফডিসির বেহাল এই অবস্থা মানতে পারিনি। রং নেই। চারদিকে আবর্জনা। যে এফডিসি আমাদের এত কিছু দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, কত মানুষের রুটিরুজি এখান থেকে, সেই এফডিসির এই হাল সত্যিই কষ্টের। চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি, বেড়া দিয়ে রাখছে। কী অদ্ভুত!
কাউকে না জানিয়েই গিয়েছিলেন?
কাউকে বলে যাইনি। মনটা চেয়েছে, তাই গিয়েছি। কাউকে জানিয়ে গিয়ে কী লাভ? দুইটা ফুলের মালা পরিয়ে দিত। এরপর তো শেষ। নতুনদের কথা আর কী বলব।
নতুনদের কারও কাজ দেখা হয়?
কারও সঙ্গেই দেখা হয় না। এখন কারা কাজ করছে, তাও তো জানি না। আগের মতো ‘চিত্রালি’ পত্রিকা নেই, সিনেমার খবরও রাখি না। সত্যি বলতে, কে আসছে, কে যাচ্ছে, কোন ছবিটা হিট হচ্ছে, কোনটা ফ্লপ—এখন আর এসব খবর জানা যায় না। তাই এসবের কিছুই জানি না।
সর্বশেষ কোন ছবিতে অভিনয়ে করেছিলেন?
কাজী হায়াতের ‘আম্মাজান’। মান্নার পর এখন শাকিব খান ছবি করছে। অপু বিশ্বাসকে চিনি। শাকিব খান আর অপু জুটি হয়ে অনেক ভালো ছবি করেছে। এরপর আর কে বা কারা আসছে, জানি না। টেলিভিশনে শাকিবের সিনেমা দেখি, সিনেমার গান শুনি। এভাবেই আরেকটু জানা। শাকিব খান আর আমার একসঙ্গে কাজ করা হয়নি। একসঙ্গে কাজ হলে হয়তো অনেক কিছু জানা হতো। শুধু জানি, সে অনেক দিন ধরে সিনেমায় কাজ করছে।
‘আম্মাজান’ সিনেমার পর কোনো শুটিং ফ্লোরে যাননি?
‘আম্মাজান’ সিনেমার শুটিংয়ের পর কোনো স্টুডিওতে যাইনি, কোনো অনুষ্ঠানেও যাইনি। অনেক ব্যাপার আছে, প্রাণখুলে সেসব বলতে পারছি না। পারব না। আর বলে লাভও হবে না। আমার মুখ পুরোপুরি বন্ধ। অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে আসার পর যা কিছু পেয়েছি, যা দেখেছি, তা নিয়ে মুখ খুলতে চাই না। এর মধ্যে কোনো একদিন শুনবেন, আমি মরে গেছি। তখন এফডিসির লোকজন অস্থির হয়ে উঠবে, সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি তো আমার ছেলেকে স্পষ্ট বলে দিয়েছি, আমার মরদেহ যেন কোনোভাবেই এফডিসিতে না যায়। রবিন (রবিন ঘোষ, প্রখ্যাত সুরকার ও সংগীত পরিচালক, শবনমের স্বামী) সাহেবও বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মরদেহও সেখানে নেওয়া হয়নি।
যে এফডিসিতে দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন, দিনের অনেকটা সময় থেকেছেন, সেই জায়গা নিয়ে এত অভিমান?
অবশ্যই কারণ আছে। আমি তো বলেছি, বলব না। এফডিসি থেকে কত সম্মান পাচ্ছি, তা তো বলে শেষ করতে পারব না! হ্যাঁ, এটা ঠিক, মরে গেলে ফুলের মালা দেব, হয়ে গেল, তাই না। এই সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। কাউকে আমার মরদেহ নিয়ে মায়াকান্না কাঁদার সুযোগ দেব না। আমি যেভাবে নিজের বাসায় চুপচাপ আছি, সেভাবেই ভালো আছি। শান্তিতে আছি। আমি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চাই না। আমি শিল্পী। আমি আমার মতো আছি। খুব ভালো আছি।
আপনার সমসাময়িক কারও সঙ্গে দেখা হয়?
ফেরদৌসী আপা (ফেরদৌসী রহমান) আর রুনা লায়লার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। হাদী ভাই (সৈয়দ আব্দুল হাদী), যাঁরা পুরোনো মানুষ, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। তাঁরা আমাকে সম্মান করেন, আমিও তাঁদের সম্মান করি। ববিতা, চম্পা, সুচন্দার সঙ্গে আলাপ হয়। এই তো কদিন আগে শফি বিক্রমপুরী ভাইয়ের বিবাহবার্ষিকীতে অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। সেদিন মৌসুমী ছিল, ওমর সানী ছিল। তারা আমাকে খুব সম্মান করে, আমিও তাদের আদর করি। শাবনূরকে চিনি। শাবনূরের সঙ্গে ববিতার বাসায় একদিন দেখা হয়েছে। মৌসুমীর সঙ্গে ‘আম্মাজান’ ছবিতে অভিনয় করেছি। অপু বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়। সাবিনা ইয়াসমীনের সঙ্গে দেখা হয় না। রুনা লায়লার সঙ্গে পাকিস্তান থেকে আমার সম্পর্ক। তাঁর বড় বোন দিনা ছিল আমার বন্ধু। সেই সূত্রে রুনা আমার ছোট বোনের মতো।
এফডিসির চলচ্চিত্র দিবসের অনুষ্ঠানে আপনাকে দেখা যায়নি।
আমার বাসায় দাওয়াতপত্র এসেছিল। দাওয়াতপত্রে মূলধারার চলচ্চিত্রের কারও নাম দেখিনি। এফডিসিতে তো এখন সমিতিতে ভরে গেছে। আমাদের সময় এমনটা ছিল না। পরিচালকদের একটা সমিতি ছিল, সবাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এখন এফডিসি রাজনীতি করার জায়গায় পরিণত হয়েছে। অথচ আমাদের সময় যখন এফডিসি ঢুকতাম, মনে হতো আরেকটা বাসায় আছি। সম্পর্কটা এমন, কেউ খালু, মামা, চাচা—কী চমৎকার সম্পর্ক ছিল আমাদের। এই সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ শেষ করে আমরা এফডিসি থেকে বের হতাম। শিল্পীদের মধ্যেও কী আন্তরিক সম্পর্ক ছিল! নিজেদের মধ্যে কেউ কখনো ঝগড়া হতে দেয়নি। এখন তো কাউকে কাউকে স্যার আর ম্যাডাম ছাড়া নাকি ডাকা যায় না।
এফডিসির অভ্যন্তরে সমিতির কার্যালয় থাকলে কী সমস্যা?
শুনেছি, এফডিসিতে এখন নাকি ১৭টি সংগঠনের কার্যালয় আছে। অথচ সিনেমার অবস্থা দেখুন। সিনেমার গল্প নিয়ে ভাবার সময় নেই। টেকনিক্যাল দিকে উন্নয়নের কোনো ভাবনা নেই। নিজেদের উন্নয়ন নিয়ে কেউ ভাবছে? সবাই শুধু সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত। যে চলচ্চিত্রকে নিয়ে সংগঠন, সেই চলচ্চিত্র যদি না থাকে, তাহলে এসব সংগঠনের কোনো প্রয়োজন আছে? এত সংগঠন থাকায় আজ চলচ্চিত্রের এই অবস্থা। এখনো আগের সময়ের সিনেমা নিয়েই আলোচনা হয়। তাহলে আমাদের কী উন্নতি হলো? আমি তো বলব, অবনতি হয়েছে। চলচ্চিত্রে আমাদের কত এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা কি হয়েছে? আমরা শুধু নিচেই নামছি।
আপনার দৃষ্টিতে এর বাধা কী কী?
আগের মতো মেধাবী পরিচালক নেই, গল্প লেখক নেই, টেকনিশিয়ান নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। এখন তো কেউ ক্যামেরা চালাতে পারলেই সিনেমা হয়ে গেছে মনে করেন। সিনেমা বানাতে হলে গল্প জানতে হবে, গল্প বুঝতে হবে, গান বুঝতে হবে, সম্পাদনা বুঝতে হবে—আরও কত–কী! এ সময়ের ছবির কথা বেশি দিন কেউ মনে রাখে না। গানগুলো মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পারছে না। কারণ, বেশির ভাগই মূল কাজ থেকে সরে গিয়ে অন্য কাজে বেশি মনোযোগী। অথচ যেটা আসল কাজ, সেটা তারা মন দিয়ে করছে না। আগে সবাই কাজ করত, তাই অন্যের পেছনে লেগে থাকার জন্য সময় ছিল না। কাজকে ইবাদত মনে করত, তাই তো এসব কাজ কালের সাক্ষী হয়ে আছে। ৫০ বছরেরও বেশি সময় আমি সিনেমায় কাজ করেছি। ১৯৫৮ সালে প্রথম সিনেমায় কাজ শুরু করি। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানে যাই। এরপর আবার দেশে এসে কাজ করেছি। অগণিত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি, এসবই আমাকে তৃপ্তি দেয়।
আপনারা তো সিনেমার অভিভাবক...
এমন অভিভাবক হয়ে কী লাভ! কোনো সম্মান নেই। মারা গেলে এফডিসিতে নিয়ে যাবে, মরদেহে ফুলের তোড়া দেবে! এফডিসি কর্তৃপক্ষ আমাদের কোনো মূল্যায়ন করেনি। আমাদের ছাড়াই তো এফডিসি চলছে। সমিতিগুলো আরও জটিলতা তৈরি করেছে। ‘আম্মাজান’ ছবির কাজ করার সময় এফডিসিতে যাইনি। যেখানে আমার অন্য রকম এক জীবনের শুরু হয়েছিল, সেখানে এখন যাওয়ার নাম নিতে পারি না, বুঝতে পারছেন? এফডিসিকে এখন আমার কাছে কবরস্থান মনে হয়।
এখন কীভাবে সময় কাটান?
আমার পরিবার, শ্বশুরবাড়ি, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ভালোই আছি। বাসায় থাকি। টেলিভিশন দেখি। গান শুনি। রান্না করি। ছেলে ঢাকায় এলে ওর জন্য রান্না করি। কখনো কখনো নিজের জন্য রান্না করি। জীবন তো চলেই যায়। নিজের পুরোনো ছবিগুলো দেখি। রবিনের গান অনেক শুনি। আলাউদ্দীন আলী, খান আতাউর রহমানের গানও শুনি। স্মৃতি নিয়েই আমি আছি। কাউকে বিরক্ত করছি না।