লাভ লেটার্স নাটকে পাঠাভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার
লাভ লেটার্স নাটকে পাঠাভিনয় করছেন ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদার

থিয়েটারের লাভ লেটার্স: নবীন বাংলার হৃৎকম্পনরেখা

চিঠি লেখা ব্যাপারটাই যেখানে উঠে গেছে, যেখানে নাটকের নাম ‘লাভ লেটার্স’! মানে, প্রেমপত্র! ঢাকার পোড়খাওয়া নাটকের দল থিয়েটার কি আমাদের সঙ্গে রহস্য করছে? হেমন্তের আবেশ-ছড়ানো ৯ ডিসেম্বর সন্ধেটা বেইলি রোডের মহিলা সমিতি মিলনায়তনে কাটিয়ে এসে ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ / আসিতে তোমার দ্বারে’, মনে হলো ঘটমান কাল যেন মরুতীর আর অতীত যেন সুধাশ্যামলিম পাড়ের আহ্বান।
ওয়াকিবহাল মহল জানেন যে রোমন্থনই হলো বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ধ্রুবপদ। এই রোমন্থনের আশ্রয় মূলত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ‘লাভ লেটার্স’-এর অবলম্বনও রোমন্থন। ফারাক দুটো। এ নাটকের বাদী সুর প্রেম। সমবাদী সুর ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ দশকজুড়ে ঢাকার উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। তার দুই প্রতিনিধি—অনন্ত চৌধুরী (রামেন্দু মজুমদার) ও মাইশা ইসলাম (ফেরদৌসী মজুমদার)। শৈশব-কৈশোর-বয়ঃসন্ধি ছাড়িয়ে এই প্রেমের পর্ব পাখনা মেলল দুরন্ত যৌবনে। গেল বহুদূরে—প্যারিসে, লন্ডনে। কিন্তু হায়! প্রেমের পথে পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেল মহাদেশীয় মহাসাগরীয় ব্যবধান। চোরাবালির মতো প্রৌঢ়ত্বে এসে সেই প্রেম থিতু হলো সোনার বাংলায়, ঢাকা-চট্টগ্রামের চিরকালের টানাপোড়েনে। শেষের কবিতার অমিত-লাবণ্যর প্রেমের মতো অনন্ত-মাইশার প্রেমও দাম্পত্যের চেনা ছাঁচে ঢালাই হলো না। অনন্ত বিরহে লীন হলো।
এই মন-কেমন-করা উপাত্ত নিয়ে মন-ভালো-করা এক নাটক লিখেছেন আবদুস সেলিম। নাম দিয়েছেন ‘লাভ লেটার্স’। এদিকে ‘নাটক’ বলতে চোখা সংলাপের যে গাঢ় বুনট আমরা খুঁজি বা কথায় কথা জুড়ে যে নিবিড়তার প্রত্যাশী হই, তার কোনোটাই এখানে নেই। যা আছে, তা হলো একতাড়া প্রেমপত্র।

প্রেমপত্রের লিখনে যা ঘটে আর পঠনে যা ঘটে, তার মধ্যে যে কত কত নাটকীয় সম্ভাবনা নিহিত, এ নিয়ে রসিক পাঠকের সামনে সাতকাহন ফাঁদার দরকার নেই। কিন্তু সেই সব সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে নাট্যকলার মতো তিলোত্তমাশিল্পের নানান উপকরণের মিলমিশ ঘটানোর জন্য একজন কুশলী নির্দেশক দরকার। থিয়েটারের নির্দেশক ত্রপা মজুমদার পেরেছেন পাঠ-অভিনয়ের মামুলি ছাঁদের মধ্যে অসংখ্য অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে একটি বর্ণাঢ্য বহুস্তরী প্রযোজনা নির্মাণ করতে। জমজমাট মসলা আর জবরদস্ত বাবুর্চির হাতযশে ‘লাভ লেটার্স’ হয়ে উঠেছে এক মনোগ্রাহী অভিজ্ঞতা। মনোরঞ্জকও বটে!

নাটকের শেষ দৃশ্যে রামেন্দু মজুমদার–ফেরদৌসী মজুমদার জুটি

আবদুস সেলিমের এই মঞ্চপাঠের আড়ালে আছে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন মুলুকে সাড়া ফেলে দেওয়া ‘লাভ লেটার্স’। আলবার্ট রামসডেল গার্নির লেখা এই নাটক এর আগেও বঙ্গীকৃত হয়েছে, পরেও হবে। উর্দুতে এর একটি অনবদ্য উপস্থাপনা করেছিলেন ফারুখ শেখ আর শাবানা আজমি—তুমহারি অমৃতা নামে। দশক দুই আগে ঢাকা সে নাটক দেখেছে। মনে রেখেছে। ফারসি-রাঙানো উর্দু জবানে মোহব্বতের বাহার খোলে ভালো। জমাট খুনসুটি হয়। জাভেদ সিদ্দিকী তার ষোলো আনা উশুল করেছিলেন। তৎসম-তদ্ভবের বাংলায় রং–তামাশা সে তুলনায় মাঠো। তা সত্ত্বেও আবদুস সেলিম যে বাজি মারলেন, তার মূলে আছে প্রেক্ষাপট রচনার মুনশিয়ানা। পাকিস্তান আমলের নানান কালচিহ্নকে বুড়ি ধরে এগিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির অন্ধিসন্ধিতে অনায়াস যাতায়াতের হিম্মত। মাইশা ইসলামের মধ্যে নভেরা আহমেদের মতো বর্ণময় শিল্পীর জীবনকে রঙিন সুতায় বুনে নকশিকাঁথা তৈরির মুরোদ।

বাকিটা বুঝে নিলেন নির্দেশক ত্রপা। ঢাকার উচ্চমধ্যবিত্ত জীবনের একদিকে রাবীন্দ্রিক প্রবণতা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিকতার অনুভব—এই দোরোখা অস্তিত্বকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য আবহসংগীতের বড় ভূমিকা ছিল। কখনো উঁচু, কখনো নিচু পর্দায় সেসব ইশারা ছড়িয়ে লাভ লেটার্স-এর নাট্যশরীর নির্মাণ করলেন ত্রপা। পর্বান্তরের অবকাশে আবছা আলোয় রবিন বসাক ও নাজমুন নাহার নাজুর তৎপরতায় দুই কুশীলবের পরিচ্ছদের সামান্য রদবদল ঘটিয়ে, মাইশা ওরফে ফেরদৌসীর কেশবিন্যাসের তরবেতর ঘটিয়ে, অনন্ত ওরফে রামেন্দুর স্টাডি টেবিলে রাখা স্যান্ড ক্লক উল্টেপাল্টে দিয়ে আমাদের মতিগতিকে হাতে রাখলেন। পলাশ হেন্ড্রি সেনের ছিমছাম মঞ্চ পরিকল্পনার কেন্দ্রে ছিল আপ-সেন্টারস্টেজে রাখা বনেদি বাড়ির সদর দরজা। তার বাঁ দিকে মাইশার জগৎ, ডান দিকে অনন্তর। আপন আহসানের হাতযশে যে ভিডিও প্রজেকশন ওই সাদা সদর দরজার ওপর পড়তে থাকল, তা শ্রাব্য নাটকের সমান্তরালে একটি সম্পূরক দৃশপট তৈরি করল। আমাদের কল্পনাকে ভিত দিল। প্রদীপ চক্রবর্তীর রেখা ওই চিত্রমালাকে এক সীমান্তহীন মাত্রা দিচ্ছিল। একেবারে শেষে রামেন্দুর হাতের লেখা আর ফেরদৌসীর মুখের রেখাকে এস্তেমাল করে যে নিটোল দৃশ্যমিশ্রণ করলেন আপন, তা এই প্রেমের নাটকের অন্তর্লীন বিরহকে আরও ঘনীভূত মাত্রা দিল।
এহ বাহ্য।‘ লাভ লেটার্স’-এর তুরুপের তাস মজুমদার দম্পতি। উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলার এই দুই মানী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে কুশীলব হিসেবে পেয়ে আট আনা বাজি আগেভাগেই মেরে দিয়েছিল থিয়েটার। রামেন্দুর স্বরগ্রাম মধ্যসপ্তকজুড়ে ধীরেসুস্থে ওঠানামা করে।

অনন্ত চৌধুরীর ভূমিকায় রামেন্দু মজুমদার ও মাইশা ইসলামের চরিত্র রূপায়ণ করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার

অনন্তর চরিত্রের সঙ্গে দিব্যি মানানসই হলো তা। আয়ত চোখের মিঠে–কড়া অভিব্যক্তিতে আর কণ্ঠস্বরের আচমকা ভাঙচুরে ফেরদৌসীর পুরোনো চাল যে আজও ভাতে বাড়ে—এ নাটকের প্রত্যেক দর্শক তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। দুজনেই বসে বসে রিডিং লাইটের আলোর সামনে পেতে রাখা এয়ারমেইলের নকশা-কাটা কার্ড দেখে দেখে চিঠি পড়েছেন। কদাচিৎ এদিক-ওদিক দেখেছেন। কিন্তু রচনা ও সম্পাদনাগুণে ওই পত্রালাপ ক্রমে ক্রমে সংলাপের চেহারা নিয়েছে। এক ঘণ্টার এই নাটক যত এগিয়েছে, আমাদের মনে হয়েছে প্রবীণ দুই প্রেমিক নিজেদের উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের এক অন্তরঙ্গ ইতিহাস হয়ে উঠছেন।
পুনশ্চ: মুনীর চৌধুরী আর ওঁর স্ত্রী লিলির প্রেমপর্বের এক খুশবুদার দলিল ওঁদের চিঠিপত্র। সেসবই সংরক্ষিত ও প্রকাশিত। যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন কী স্পন্দমান সেই অন্তরঙ্গ পত্রাবলি। পারিবারিক সূত্রে চৌধুরী দম্পতির উত্তরাধিকার বইছেন মজুমদার দম্পতি। গেল ৫ মে প্রথম মঞ্চায়িত ‘লাভ লেটার্স’ যে প্রতিশ্রুতির জন্ম দিল, আসছে বছর মুনীর-লিলির পত্রায়িত প্রেমের খেই ধরে তা পরিপূর্ণতা পাক।

অংশুমান ভৌমিক, পশ্চিমবঙ্গের নাট্য সমালোচক