‘আদম সুরত’ প্রযোজনাটি নিয়ে কেন আমি এত মুখর হয়ে উঠছি? কেন উচ্ছ্বসিত বারবার? অথচ এই নাটকের টেক্সট নিয়ে কথা বলার আছে। নাট্যকার আর একটু রাশ টানতে পারতেন তাঁর ন্যারেটিভে আসা বহু ঘটনার। সময় সংক্ষেপ করতে পারতেন। এসব করলে চলতি মতে ভালো হতো, কিন্তু সময়ের প্রতি ক্রুদ্ধ এক নাট্যকার, যাঁকে এই শহরে বেড়ে উঠতে উঠতে রোজ প্রায় অসহনীয় ঘটনাগুলো সহনীয় করার ছল করতে হয়েছে, বহুদিনের জমে ওঠা রাগ প্রকাশ করতে চাইছেন তাঁর নাট্যের বিষয় বিন্যাসে, তিনি নিজেকে কি করে সংযত করবেন? আর প্রায় জনাপঞ্চাশ তরুণ-তরুণীর অসাধারণ পারফরম্যান্সে যে সময় ঘাটতি হতো আমাদের। তাহলে তো এই প্রযোজনা দেখতে পেতাম না। এত প্রাণশক্তিতে ভরপুর প্রযোজনা অনেক দিন দেখিনি।
বাংলাদেশে বহু নাটক দেখার সুবাদে বলতে পারি, অনেক ভালো কাজ দেখেছি। কিন্তু এমন ক্রুদ্ধ, এমন জোরালো ঘটনার নির্মমতার প্রকাশ মঞ্চে কম দেখেছি। এই নাটকের ধরনে নাটক এখানে হয়নি, তা কিন্তু নয়। তবে পুরো কাজের মধ্যে এত ভরপুর এনার্জি, এত ক্রোধ অভিনেতাদের মধ্যে জারিত হতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। হয়তো হয়েছে, আমি দেখিনি। তাই আবেগ-উচ্ছ্বাস বেশি করে ফেলছি হয়তো।
থিয়েটার ছোট হতে হতে এমন এক সরলপথ আবিষ্কারে ব্যস্ত যখন আমরা, তখন পরপর দুটি কাজ দেখলাম বহু চরিত্র, বহু ঘটনা, অনেক বড় ক্যানভাসে তৈরি থিয়েটার।
তাডুয়ার দ্বিতীয় প্রযোজনা ‘আদম সুরত’ অনেক দিক থেকে মনে রাখার মতো। মূল চরিত্র হিসাবুল নিজেকে দেখে মাটির নিচে, অপেক্ষার সময় নিয়ে আবিষ্কার করতে থাকে রংচটা এক ছেলেবেলা। সেখানে প্রিয় মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে কুকুর হত্যার জেনোসাইড, লতা কাকার পচা লাশ, মর্গে আবিষ্কৃত মৃত তরুণীর দেহ।
তার যৌবন মিশে আছে বাবার হাতকাটা লাশ, মাংসের দোকানে মানুষের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি, সোনামুখির প্রেম গ্রহণ করতে না পারার অসহায়তা। নাটকের এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে কেবলই নৃশংসতা-নির্মমতার ছবি এঁকে চলে নাট্যকার আর অভিনেতার দল। মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায় দৃশ্যপট, প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে আমাদের চোখের সামনে, মনের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যায় যেন এক নৃশংসতা থেকে অন্য এক নৃশংসতায়। যতক্ষণ চলতে থাকে, প্রযোজনা ততক্ষণ ভীষণ এক অস্থিরতায় ডুবেছিলাম আমরা। তারপর সব থিতু হতে মনে হলো, এ তো আমারও চেনা জগৎ। শুধু চেনা নয়, আমার শৈশব-যৌবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই যেন ঘটে গেল এক আশ্চর্য নাট্যবিন্যাসে।
নাট্যকার-নির্দেশক বাকার বকুল কাজটা করলেন প্রায় জনাপঞ্চাশ অভিনেতা-অভিনেত্রীর অসাধারণ পারফরম্যান্সে।
মুহূর্তে মুহূর্তে বদলায় দৃশ্যপট, প্রবলভাবে আছড়ে পড়ে আমাদের চোখের সামনে, মনের মধ্যে তোলপাড় হয়ে যায় যেন এক নৃশংসতা থেকে অন্য এক নৃশংসতায়।
পরিচালক নিজেই জানিয়ে দেন, ‘নির্দেশনার ক্ষেত্রে আদম সুরতের প্রেক্ষাপট নির্বাচনে আমার মনোযোগ রাজনৈতিক-সামাজিক অসংগতি চিহ্নিতকরণে। বালুধুমরাশি অশিক্ষার ছাঁচে বেডে ওঠা মগজ পচা এক জনসমষ্টি। সংখ্যালঘু মুক্তচিন্তাশীল কথা বলা মানুষ এখানে নিঃসঙ্গ-অস্পৃশ্য এবং আক্রমণের শিকার। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমরা উল্লিখিত বিষয়াদি নাট্যমঞ্চে জুড়ে দিতে কিংবা পুরে দিতে চাই।’ বস্তুত এটাই এই নাট্যের বিষয়। বাকার বকুল ভীষণ সত্য রূপে তার পারফরম্যান্সকে গড়ে তুলতে পেরেছেন।
এটা একটা টিমওয়ার্ক। তাই অভিনেতাদের কারও নাম আলাদা করে উল্লেখ করতে চাইছি না; বরং নাম নিতে চাই সংগীত পরিচালক সমুদ্র প্রবাল, আলো ভাবনার পলাশ হেনড্রি সেন, কোরিওগ্রাফার ফরহাদ আহমেদ শামীম—তাদের নাম। পরিচালক আসলে উত্তীর্ণ তাদের হাত ধরে। কাজটা চালিয়ে যাওয়া কঠিন, তবু চলবে আশা করি, তারুণ্যের জোয়ারে।
আশিস গোস্বামী, নাট্য সমালোচক