আহাম্মেদ আলীর ঢোলের তালে আর বিজয় দাসের কর্নেটের সুরে ২৩ জন ছেলেমেয়ে গাইছে একটি গান, ‘আল্লাহ-ঈশ্বর করি গো স্মরণ করলাম গুণীজন, আনর্ত নাট্যমেলায় যাঁরা প্রাণেরও মতন।’ কিন্তু কর্নেটের সঙ্গে গলা মিলছে না, নাকি গলার সঙ্গে কর্নেট যেতে পারছে না। এ নিয়ে বিসংবাদ। আবার কর। ছেলেমেয়েরা আবার হাত-পা নেড়ে সুর ধরছে। গতকাল রোববার সকাল থেকে চলছে এই চর্চা। তখন আনর্তঘরের নামফলকটা লেখা হয়নি। একটি মেয়ে মইয়ে উঠে সেটি সম্পন্ন করার চেষ্টা করছে। সিঁড়িটা ঠিক করছে ঊষা, রোজ, তাসনিম ও মৌ। কাঠের সরঞ্জামগুলো টেনেটুনে ঠিকমতো জায়গায় নিচ্ছে তুহিন। রহমান রাজু পরিচালকের মতো নাটকের পাণ্ডুলিপির মতো একখানা কাগজ হাতে এর-ওর কাছে দৌড়াচ্ছেন।
সবকিছুকে ছাপিয়ে মাঝেমধ্যে উচ্চ স্বরে বেজে উঠছে কর্নেট। বাড়ি পড়ছে আহম্মদ আলীর ঢোলে। তার সঙ্গে যেন কান্নার সুরে বেজে উঠছে আবু বাক্কারের মন্দিরা। কয়েক দিন ধরে এসবই চলছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবনের সামনে। এখানেই দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ‘আনর্ত নাট্যমেলা ২০২৪’।
দুই দিনব্যাপী এই মেলার উদ্বোধন করা হয়েছে আজ সোমবার সকালে। থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা ‘আনর্ত’ এই মেলার আয়োজন করেছে। বাদ্যযন্ত্রীরা এসেছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে। তাঁরা দীর্ঘদিন যাত্রা-নাটকে এই যন্ত্র বাজিয়েছেন। এখন তাঁদের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে, কিন্তু প্রাণে সেই দোলা রয়েছে। অনুশীলনের অবসরে দেখা গেল একটা স্টলে বসে আপন মনে কর্নেটে নতুন নতুন সুর তুলছেন সাহেব আলী।
পুরো মেলার আঙিনার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আনর্তবাড়ি’। আর মঞ্চের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আনর্তঘর’। গ্রামের বাড়ির মতো খড়ের বেড়া দিয়ে আঙিনা ঘিরে ফেলা হয়েছে। পুরো আঙিনাকে গ্রামের বাড়ির উঠানের মতো গরুর গোবর দিয়ে নিকানো হয়েছে, যাতে পায়ে ধুলা না ওড়ে। এই উঠান লেপার কাজটিও করেছেন নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কয়েক দিন ধরে রাতে এই কাজ করা হচ্ছে। আজ দুপুরে গিয়ে দেখা গেল কোথাও আর ধুলা নেই। পুরো আঙিনা যেন সত্যিই গ্রামের বাড়ির একটি উঠান। আর স্টলগুলো ঘিরে দেওয়া হয়েছে খড়ের বেড়া দিয়ে।
সামনে একটি ফটক তৈরি করা হয়েছে। সেটিও খড়ের। আর মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে চাটাই দিয়ে।
‘আনর্ত’ পত্রিকার সম্পাদক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজুকে প্রস্তুতির এই কাজে সহযোগিতা করছেন বিভাগের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। রহমান রাজু কানে ফোন ধরে আছেন। কোন নাট্যদল রাজশাহীতে এসে পৌঁছাল সেই খবর নিতে, তাঁদের থাকার জায়গা কোথায় হবে—সেই সব নিয়ে।
সন্ধ্যায় রহমান রাজু ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে। ইতিমধ্যে এসে পড়েছে ঢাকা থেকে দেশনাটক, গাইবান্ধার সারথি, সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনে আসছে ভারতের মধ্যমগ্রাম নৃত্যবিতান—এসব খবর নিয়ে চলছে ছোটোছুটি। কথা বলতে বলতেই ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম থেকে আসা অতিথি শিশির দত্ত ও নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত রবিউল আলমকে অভ্যর্থনা জানাতে।
এ প্রতিবেদন লেখা হয়েছে গতকাল রোববার সন্ধ্যায়। তখন জানা গেল লাকি ইনাম আসতে পারছেন না। ঢাকায় কী যেন একটি অনুষ্ঠানে আটকে গেছেন। লিয়াকত আলী লাকি এখনো কলকাতায়। রাতের ফ্লাইটে ফিরতে পারলে পরে জানাবেন।
অন্য অতিথিদের মধ্যে মামুনুর রশীদ, গাজী রাকায়েত, আবদুস সেলিম, তারিক আনাম খান, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মলয় ভৌমিক, রতন সিদ্দিকী, অরুণা বিশ্বাস, শহীদুল আলম সাচ্চু, মাসুম রেজা, বন্যা মির্জা, সালাউদ্দিন লাভলু, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, মোহাম্মদ বারী, ওয়াহিদুল ইসলাম, বাবুল বিশ্বাস, অভিজিৎ সেনগুপ্ত, সেলিম রেজা সেন্টু, জাহেদুল আলম, পাভেল রহমান, ইউসুফ ইকবাল, কামরুল হাসান খান, ইস্রাফীল শাহীন, রশীদ হারুন, ইউসুফ হাসান অর্ক, সাইদুর রহমান লিপন, আহমেদুল কবীরসহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ স্থানীয় অতিথিরা থাকছেন।