নিয়মিত সৎ নাটক মঞ্চায়ন ও নাট্যবিষয়ক একটি পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে প্রায় ২৫ জন সদস্য নিয়ে ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পথচলা শুরু করে নাট্যদল থিয়েটার। একই বছর নাটকের পত্রিকা প্রকাশ করলেও নাট্যদল থিয়েটার প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করে ১৯৭৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তাদের প্রথম নাটক শহীদ মুনির চৌধুরীর ‘কবর’। দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটার নিয়মিত মঞ্চায়ন শুরু করে ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে আবদুল্লাহ আল–মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’ নাটক দিয়ে।
থিয়েটার নাট্যদলের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক মমতাজউদদীন আহমদ রচিত ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’। ১৯৮৯ সালের মে মাসে প্রথম মঞ্চস্থ হওয়া নাটকটি ৬ বছর একটানা ২০০ বারের বেশি প্রদর্শিত হয়। অন্য কোনো নাটক একটানা এতবার প্রদর্শিত হয়নি। টানা ৯ বছরের বেশি সময় ধরে সমানভাবে দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছিল নাটকটি।
জীবনের আনন্দের মাধ্যমে দর্শকদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনায় সচেতন করে তোলার জন্য নির্মিত এই নাটক ৩০০ বারের বেশি প্রদর্শিত হয়েছে।
৫০ বছরের এই পথচলায় নাট্যদলটি মঞ্চস্থ করেছে মাত্র ৪২টি নাটক। এর মধ্যে নয়টি পথনাটক ও তিনটি একাঙ্কিকাও মঞ্চস্থ করেছে। দেশ–বিদেশ নিয়ে থিয়েটারের প্রদর্শনীসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। নাটকের সংখ্যা কম হলেও থিয়েটারের নাটকগুলোর মধ্যে ছিল বৈচিত্র্য। এ ছাড়া থিয়েটার সময়ের দাবি অনুসারেও নাটক মঞ্চস্থ করেছে। নাটক মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা। ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ তারই প্রমাণ। এই নাটক যখন মঞ্চস্থ হয়, তখন দেশ স্বৈরশাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ। স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করেছে নাটকটি।
গত বছর ৫০ বছরে পা দিয়েছে নাট্যদল থিয়েটার। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে শনিবার শুরু হয়েছে আট দিনব্যাপী নাট্যোৎসব। শনিবার সকালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ৪ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে এই উৎসব। উৎসবের প্রথম দিন জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মঞ্চে প্রদর্শিত হয়েছে লোক নাট্যদলের ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’, নাট্যকেন্দ্রের ‘পুণ্যাহ’ ও মৌলভীবাজারের দৃষ্টিপাত নাট্য সংসদের ‘অন্তহীন মুক্তিযুদ্ধ’। নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয়েছে যথাক্রমে জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়, পরীক্ষণ থিয়েটারে সন্ধ্যা সোয়া সাতটায় ও স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা সাতটায়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী এই নাট্যোৎসবের উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। এই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি প্রাবন্ধিক গবেষক গোলাম কুদ্দুছ, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল চন্দন রেজা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন দলের সভাপতি নিলুফার বানু। অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করেন গীতাঞ্জলি একাডেমি অব ফাইন আর্টসের শিল্পীরা।
অনুষ্ঠানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি প্রাবন্ধিক–গবেষক গোলাম কুদ্দুছ বলেন, বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারের চর্চা যারা শুরু করেছে, তাদের অন্যতম থিয়েটার। দর্শকনন্দিত বহু ধরনের বিভিন্ন ধারার নাটক তারা মঞ্চস্থ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র–নজরুল এবং বিখ্যাত নাট্যকারদের নাটক নির্মাণ করে নাটকের দর্শক তৈরি করেছে থিয়েটার। এ ছাড়া নতুন নতুন অসংখ্য নাট্যকর্মী ও দর্শকের রুচি তৈরি করেছে তারা।
তবে গোলাম কুদ্দুছ একটা আশঙ্কার কথাও বলেন। তিনি বলেন, বর্তমান সময়কে ধরে যদি নাটক নির্মাণ করা না হয়, তাহলে নাটকের দর্শক যেমন কমবে, তেমনি নাটকের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমে যাবে। তিনি আরও বলেন, ‘থিয়েটার দেশের নাট্যদলগুলো নিয়ে যে উৎসবের আয়োজন করছে, তা তাদের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। একই সঙ্গে আমরা খুশি হব নতুন নতুন কালজয়ী নাটক অতীতের মতো মঞ্চে আমাদের উপহার দিলে।’
এ ছাড়া এই অনুষ্ঠানে তিনি অনুরোধ করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাঠে যেন বাণিজ্যিক মেলার আয়োজন যাতে না করা হয়। তিনি বলেন, একসময় এই মাঠে বাণিজ্যিক মেলা হতো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ হতে লিখিতভাবে জানানো হলে শিল্পকলা একাডেমির মাঠে সংস্কৃতিবিষয়ক মেলা ছাড়া অন্য কোনো মেলা অনুষ্ঠিত হতো না। অনেক দিন এই মাঠে বাণিজ্যিক মেলা না হলেও এখন আমমেলা, তাঁতমেলা, মৎস্যমেলাসহ একাধিক মেলা চলছে। এভাবে যদি বাণিজ্যিক মেলা চলতে থাকে, তাহলে শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হল এবং সংগীত ও আবৃত্তি মিলনায়তন—এই মঞ্চগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া সংস্কৃতিক অনেক আয়োজন শুধু জায়গার অভাবে এখানে আয়োজন করা যায় না।’
এই নাট্যোৎসব থিয়েটারের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার দ্বিতীয় পর্ব। নাট্যোৎসবে ৮ দিনে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের মোট ২২টি নাট্যদলের ২২টি নাটক প্রদর্শিত হবে। উৎসবে প্রদর্শিত অন্য নাটকগুলো হলো ৫ ফেব্রুয়ারি প্রাচ্যনাটের ‘আগুনযাত্রা’, ঢাকা পদাতিকের ‘পাইচো চোরের কিচ্ছা’ ও পালাকারের ‘উজানে মৃত্যু’। ৬ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলার শিল্পকলা রেপার্টরি নাট্যদলের ‘৩২ জানালা’, থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘আমিনা সুন্দরী’, ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠীর ‘দুরাশা ও পাখি’। ৭ ফেব্রুয়ারি থিয়েটারের ‘দ্রৌপদী পরম্পরা’, রংপুর নাট্যকেন্দ্রের ‘নীল ললিতার গীত’, বরিশালের শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের ‘উপসংহার’। ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের জেলা শিল্পকলা রেপার্টরি নাট্যদলের ‘রাজনীতির কবি’, নাট্যধারার ‘স্বর্ণময়ী’। ৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জে জেলা শিল্পকলা রেপার্টরি নাট্যদলের ‘কারাগারের রোজনামচা’, ময়মনসিংহের বহুরূপী নাট্য সংস্থার ‘আগুনমুখা’। ১০ ফেব্রুয়ারি প্রাঙ্গণেমোরের ‘রক্তকরবী’, শব্দ নাট্যচর্চাকেন্দ্রের ‘কী চাহ শঙ্খচিল’, যশোরের তির্যকের ‘চোরের লজ্জা হলো’। শেষ দিন দেশ নাটকের ‘ফেব্রুয়ারি নিত্যপুরাণ’, পদাতিক নাট্য সংসদের ‘গুঞ্জন বিবির পালা’ ও নাট্যম রেপার্টরির ‘ডিয়ার লায়ার’ মঞ্চস্থ হবে।