‘ভূরকাপাড়া’ গ্রামে মঞ্চস্থ ওরা কদম আলী নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো
‘ভূরকাপাড়া’ গ্রামে মঞ্চস্থ ওরা কদম আলী নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

ভূরকাপাড়া গ্রামে ‘ওরা কদম আলী’

নাটক শুরু হতে বেশি দেরি নেই, কিন্তু সরদারের জ্বর ছাড়ছে না! ডাক্তারের বাড়িতে ছুটে গেলেন কয়েকজন। সব শুনে ডাক্তার বললেন, যাঁরা মহড়া দেখেছেন, তাঁদের কাউকে দিয়ে এই চরিত্র করানো যায় না? এ কথা শুনে সবাই যেন ভেঙে পড়লেন, ‘সরদার হচ্ছে “মেইন ক্যারেক্টার”, তার জায়গায় কাউকে দিলেই চলবে না।’ ডাক্তার কিছু ওষুধপত্র দিলেন। জ্বর কিছুটা নেমেছে সরদারের। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার নিভৃত গ্রাম ভূরকাপাড়ায় সময়মতোই শুরু হলো ঢাকার মঞ্চে নব্বই দশকের অন্যতম আলোচিত নাটক মামুনুর রশীদ রচিত ‘ওরা কদম আলী’। সরদার চরিত্রে গায়ে জ্বর নিয়ে যথারীতি মঞ্চ মাতালেন সুখন আলী।

ভূরকাপাড়া পদ্মার দক্ষিণ তীরের খেটে খাওয়া মানুষের একটি নিভৃত গ্রাম। গ্রামের মানুষেরা নিজেদের সন্তানদের মানুষ করার জন্য সারা দিন পড়ে থেকেছেন পদ্মার চরে। আবার কেউ শ্রমিক হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ফলে তাঁদের সন্তানেরা কেউ হয়েছেন ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ কর্মকর্তা; কিন্তু তাঁরা নিজের গ্রামকে ভুলে যাননি। প্রতি ঈদে তাঁরা গ্রামে এসে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেই আয়োজনে যুক্ত হয়েছে নাটক। এবার ঈদের পরদিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ছিল গ্রামের শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা আয়োজন। ছেলেদের মোরগলড়াই খেলা, কবিতা আবৃত্তি, রিলে দৌড়, নাচ ও গান। আর রাত সাড়ে ৯টায় ছিল মঞ্চনাটক।

নাটকে কদম আলী চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সম্মান শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী সজল, সরদার চরিত্রে একই বর্ষের সম্মান শ্রেণির শিক্ষার্থী সুখন আলী। গর্ভবতী স্ত্রীর চরিত্রে সদ্য বিসিএস করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করা গ্রামের গৃহবধূ আশিফা, তাঁর স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেন বিটিসিএলের কর্মকর্তা রাসেল আহমেদ, সারেং চরিত্রে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার আল মেহেদী, আলিমুদ্দি চরিত্রে পলিটেকনিক শিক্ষার্থী আশিক, পিচ্চি চরিত্রে পলিটেকনিক শিক্ষার্থী মারুফ, তাজু চরিত্রে শিশু পরশ, পুলিশ চরিত্রে মিনারুল এবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। বই বিক্রেতা চরিত্রে তুষার পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাঁরা সবাই ঈদের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ করতে এই আয়োজন করেন।

নাটকে দেখা যায়, সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ও শিশুসন্তান তজুকে নিয়ে এক ব্যক্তি লঞ্চঘাটে আসে। স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে তার স্বামী রিকশা ডাকতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে আর ফিরতে পারে না। ঘাটেই সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার স্ত্রী মারা যায়। নবজাতক শিশুও মারা যায়। শিশু তজুকে ঘাটের ইজারাদার নায়েব আলী শ্রমিক বানাতে চায়। ঘাটের চায়ের দোকানে পানি দেয় রাবেয়া। সে চায় ছেলেটাকে মানুষ করতে। ঘাটের বইয়ের দোকানি, বোবা কদম আলী তাকে সমর্থন দেয়। এরই মধ্যে নায়েব আলী শ্রমিক রাবেয়াকে বাজে প্রস্তাব দেয়, এই নিয়ে দ্বন্দ্বে রাবেয়া নায়েব আলীর কান কেটে নেয়। এরই মধ্যে শিশু তজুর বাবা ফিরে আসে। সন্তানকে নিয়ে যেতে চায়। সবাই শিশু তজুকে বিদায় দিতে কান্না ধরে রাখতে পারে না।

‘ভূরকাপাড়া’ গ্রামে মঞ্চস্থ ওরা কদম আলী নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রথম আলো

এরই মধ্যে কানকাটার মামলায় পুলিশ ধরতে আসে, তখন রাবেয়াসহ উপস্থিত সবাই নিজেকে কদম আলী বলে পরিচয় দেয়। ধন্দে পড়ে পুলিশ তাদের আক্রমণ করতে যায়। সবাই মিলে তা প্রতিরোধ করে। ‘ওরা কদম আলী’ নাটকে এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অতিসাধারণ চিত্র গ্রামের সাধারণ দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়। দেখা যায়, বিভিন্ন দৃশ্যে তাঁরা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।  

নাটক শুরুর আগে স্থানীয় আমজাদ হোসনের বাড়িতে অতিথিদের নিমন্ত্রণ ছিল। সেই বাড়িতে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র রয়েছে। জানা গেল, আমজাদ হোসেন যাত্রাদলের যন্ত্রী ছিলেন। যাত্রায় ভাঙন শুরু হলে সন্তানদের মানুষ করার জন্য তিনি সৌদি আরবে চলে যান। ৯ বছর পর দেশে ফেরেন। তাঁর এক ছেলে ডাক্তার, এক ছেলে বিটিসিএলের কর্মকর্তা, পুত্রবধূ সরকারি কর্মকর্তা, ছোট ছেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তাঁর পুত্রবধূসহ দুই ছেলে এই নাটকে অভিনয় করেন। বোঝা গেল, পরিবারটি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্যোক্তা। আমজাদ হোসেন বললেন, ‘সৌদি আরবে যাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, এসব আমার বাড়িতে থাকবে না। তাই নালটা একজনকে দিয়ে যাই। বাড়ি ফিরে এসে দেখি, আমার ছেলেরা সব বাদ্যযন্ত্রই এনেছে।’ তাঁর ছোট ছেলের গানের গলা চমৎকার। তাঁর গান করা উচিত, না ছেড়ে দেওয়া উচিত, জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমার এক মন বলে, ছেলে গান ছেড়ে দিক। কারণ, এটাকে পেশা হিসেবে নেওয়া যায় না। আবার আরেক মন বলে, সে গান করুক। কারণ, তার ভালো লাগে।’

নাটক শুরু হলে সবাই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন। বাড়িতে থাকার কেউ নেই ভেবে ছেলেরা বাবা আমজাদ হোসেনকে রেখে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু তিনি আগে বের হতে হতে বললেন, ‘আমি বাড়িতে থাকতে পারব না, নাটকের কাছে যাব।’
রাজশাহী থেকে কুষ্টিয়ার ফিলিপনগর পর্যন্ত যেতে যেতে ঈদের আনন্দ বলতে পথে পথে চোখে পড়ল ভটভটিতে গাদাগাদি করে উঠে তরুণদের হইচই করতে করতে যাওয়া। আবার কোথাও ১০-১৫ জন একসঙ্গে মোটরসাইকেলে সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। শুধু ব্যতিক্রম ভূরকাপাড়া।