‘ভোরের সূর্যের মতো রবীন্দ্রনাথ কখনো পুরোনো হন না। যতবার শুনি, মনে হয় প্রথম শুনছি। মনে হয়, নিজের মনের কথাই শুনছি।’ মাঝের সারিতে বসা এক দর্শক এমনটা বলেছিলেন। সুপরিকল্পিত ও দৃষ্টিনন্দন অনুষ্ঠানের পুরোটা সময়ে কথাটার প্রমাণ পেয়েছি। মিলনায়তনভর্তি আমন্ত্রিত দর্শকের আন্তরিক মনোযোগ ছিল দেখার মতো। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার ১১১ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার সন্ধ্যায় এ আয়োজন করেছিল এইচএসবিসি ব্যাংক ও সুইডিশ এম্বাসি। ব্যতিক্রমী এই আসর যেমন সুচিন্তিত, তেমনি সুপরিকল্পিত।
ছিমছাম সুন্দর আয়োজন। রবীন্দ্রনাথের নানা প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছিল গুলশানের হোটেল শেরাটনের গ্র্যান্ড বলরুমের ভেতর–বাহির। ছিলেন আলফ্রেড নোবেল। ডিজিটাল পর্দায় ছিল রবীন্দ্রনাথের ছবি, গানের পঙ্ক্তি।
অনুষ্ঠানের বিন্যাসেও ছিল অভিনবত্ব। একটি প্রামাণ্য ভিডিও চিত্র প্রদর্শনের পর শুরুতে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় সমাগত ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আয়োজনের উদ্দেশ্য ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলেন সুইডেনের রাষ্ট্রদূত এইচ ই নিকোলাস উইকস ও এইচএসবিসি বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব উর রহমান।
তাঁদের বক্তৃতার পর সংগীতশিল্পী অদিতি মহসিন ও আবৃত্তিকার ডালিয়া আহমেদকে মঞ্চে ডাকেন সঞ্চালক কৌশিক শংকর দাশ। ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়’ পরিবেশনার আগে গানটির কথা ইংরেজিতে পাঠ করে শোনান ডালিয়া আহমেদ। ফলে মিলনায়তনে উপস্থিত ভিনদেশি দর্শকেরও গানের মর্ম বুঝতে বাকি রইল না। পূজা, প্রেম, প্রকৃতি পর্বের সাতটি গানের পরিবেশনা ছিল এ সন্ধ্যায়।
অদিতির মাপা-মার্জিত পরিবেশনা এ সন্ধ্যার আয়োজনে যেমন মাধুর্য ছড়াল, তেমনই ডালিয়া আহমেদের সাবলীল পরিবেশনায় তা শ্রুতিসার্থক হয়ে উঠল। বিশেষ করে ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব’ কিংবা ‘আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ’ গানের আগে ইংরেজি পাঠে ভাবটা যথাযথ পেয়েছেন শ্রোতারা।
অনুষ্ঠানে আরও ছিল ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো’, ‘মেঘের ’পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে’, ‘হার-মানা হার পরাব তোমার গলে’ এবং ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’।
আরেক আকর্ষণ ছিল ওয়ার্দা রিহাব ও তাঁর দলের নৃত্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, নৃত্যেও রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় নিয়েছেন ওয়ার্দা। গানের কথা, সুরের সঙ্গে নাচও ছিল মানানসই। এক্সপ্রেস ইভেন্টসের ব্যবস্থাপনাকে অনেককেই সুরুচিপূর্ণ বলে মন্তব্য করতে শোনা গেছে। সব মিলিয়ে মনে রাখার মতো একটি সন্ধ্যা উপহার দিলেন শিল্পীরা। দর্শকসারিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকেরা, বিভিন্ন ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ছিলেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অর্থনীতি বিশ্লেষক মামুন রশীদ, জেনারেল সেক্রেটারি অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিস অব বাংলাদেশ, ডিরেক্টার এক্সপ্রেস ইভেন্টস সৈয়দ আপন আহসান, অভিনেত্রী–নির্দেশক ত্রপা মজুমদার, আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর চিকিৎসক তাসনিম জারা প্রমুখ।
১১১ বছর আগে ১৯১৩ সালের ১৫ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে টেলিগ্রাম মারফত নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। নোবেল বিজয়ীর তালিকায় তিনি শুধু প্রথম বাঙালি বা প্রথম ভারতীয়ই নন, প্রথম এশীয়ও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকবিতাগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’ প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। বছর দুয়েক পর এই বইয়ের বেশ কিছু কবিতা এবং এর বাইরেরও অনেকগুলো কবিতার অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয় ইংরেজি গ্রন্থ ‘সং অফারিংস’। এ বইয়ের জন্যই ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পান রবীন্দ্রনাথ।