‘অচলায়তন’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে
‘অচলায়তন’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে

নব–অভিজ্ঞতার আলোকে ‘অচলায়তন’

নাটক আমাদের অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি করে। কিন্তু তার মধ্যে একটা বিষয়ই বরাবর মুখ্য হয়ে ওঠে, তা হলো দর্শক হিসেবে একটা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন। সেই অভিজ্ঞতার আকাঙ্ক্ষাতেই নাটক দেখতে আসেন দর্শক। সেই সঙ্গে এক আনন্দময় সময়ক্ষেপণ। প্রাচ্যনাটের ‘অচলায়তন’ দেখতে গিয়ে কথাগুলো আরও একবার মনে হলো।
শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষাব্যবস্থার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির এক আনন্দময় উৎসব রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন। অজড়, অনড় ভারতবর্ষের সমাজে শিশুদের প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন করে মন্ত্র মুখস্থ করার এক কঠিন কর্মপ্রয়াসে লিপ্ত করা হয়েছে। ভারতবর্ষের এই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যথার্থই চিন্তিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর চিন্তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তদানীন্তন ইউরোপীয় শিক্ষাব্যবস্থা।

যে ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নতি করেছে, সেই ইউরোপের মানুষগুলো ভারতবর্ষে কিংবা আফ্রিকা অথবা পৃথিবীর অন্য কোনো উপনিবেশে গিয়ে কী নিষ্ঠুর মানুষে পরিণত হয়! শিক্ষাব্যবস্থায় একটা গোড়ায় গলদ রয়ে গেছে, এটা তিনি ভাবতেন এবং এখান থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির শ্যামল ছায়ায় গুরু-শিষ্য পরম্পরায় প্রাচীন ভারতের তপোবন শিক্ষাব্যবস্থার কথাও ভাবতেন।

এই ভাবনা ‘অচলায়তন’ নাটকের মধ্যেও হয়েছে। পার্থক্য এই যে রবীন্দ্রনাথ নানা যুক্তিসহকারে দীর্ঘ সংলাপ রচনা করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন আর আজাদ আবুল কালাম সেসব মাথায় রেখে নাট্যমুহূর্ত সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। আর এখান থেকেই আমরা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকি।
নাটককে এক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম বলে বিবেচনা করতেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু প্রায়োগিক বিষয়গুলো তেমনভাবে তখনো গড়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথের নাটকের প্রথম সফল প্রযোজনা শম্ভু মিত্রের রক্তকরবী। দীর্ঘ অনুশীলন, মঞ্চ নির্মাণ ও আলোর ব্যবহারে খালেদ চৌধুরী ও তাপস সেনের নিরলস পরিশ্রমের ফল এই রক্তকরবী এবং পরে চার অধ্যায়।

‘অচলায়তন’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে

‘অচলায়তন’ দেখেও বোঝা যায়, নির্দেশক আজাদ আবুল কালামের দীর্ঘ দিনের প্রায়োগিক ভাবনার ফসল এই নাটক। আজাদ আবুল কালাম এর আগে রাজা করেছিলেন, সেখানেও মঞ্চকে নানাভাবে ব্যবহার করে চরিত্রগুলোকে উত্তর–আধুনিকভাবে সৃষ্টি করেছিলেন। অচলায়তন-এও কীভাবে নাটকটিকে একটি দৃশ্যকাব্যে পরিণত করা যায়, এই চ্যালেঞ্জ তিনি নিয়েছিলেন। যার জন্য একটা গতিময় দৃশ্যপট প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষেত্রে তার সহায়ক ছিলেন শিল্পনির্দেশক সাইফুল ইসলাম। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি কাজ করছেন এবং সব জায়গায় একটি নতুন কিছু করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। যেহেতু তিনি চারুশিল্পী, তাই শিল্পের ইতিহাসের বহু বাঁক তাঁর চিন্তার মধ্যে থাকে। সেই সঙ্গে থাকে নানা ধরনের ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের অভিনব পথ।

প্রাচ্যনাটের অচলায়তন-এ আমরা কতগুলো অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা হতে দেখি। যার মধ্যে একটি অসাধারণ দৃশ্যপট দর্শকদের এক মোহনীয় আবেশের সৃষ্টি করে। দৃশ্যপটটি হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠে এবং একটা সুড়ঙ্গপথের সন্ধান পাওয়া যায়।

মামুনুর রশীদ

আবার দৃশ্যপট বদলে যায়, খোলা প্রান্তর ও সবুজের দেখা মেলে, যেখানে শোনপ্রাংশুদের সন্ধান মেলে। তার মধ্যে শিশুদের চলাচলে এক প্রাণোচ্ছল অবরুদ্ধ শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। অভিনয়ের সময় চরিত্রগুলোকে একবার স্কেটিংয়ের ব্যবহার করতেও দেখা গেছে। শিশুদের চলনকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্য এই স্কেটিংয়ের ব্যবহার এক নতুন নান্দনিকতা যোগ করে। অনেকে হয়তো আঁতকে উঠবেন যে অচলায়তন-এ স্কেটিংয়ের ব্যবহার! রবীন্দ্রনাথের নাটকে বিষয়বস্তু প্রকাশে একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে সংলাপ। কিন্তু সংলাপকে একটা নাট্যরীতির মধ্য নিয়ে এসে জীবন্ত করার দায়িত্ব নির্দেশকের। কাজটি খুব সহজ ছিল না।
নাটকটি দেখতে দেখতে কখনো মনে হয়েছে যেন ব্রডওয়ে অথবা লন্ডন কিংবা জার্মানির কোনো অপেরা হাউসে নাটক দেখছি।

‘অচলায়তন’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে

অধুনালুপ্ত পূর্ব জার্মানিতে একবার মহাকবি গ্যেটের একটি প্রযোজনা দেখেছিলাম এবং সেই সঙ্গে ব্রডওয়েতে ভিক্টর হুগোর লে মিজেরব দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। দুটিই বহু আগের লেখা এপিক এবং উপন্যাস। আধুনিক কালের দৃশ্যপটের ব্যবহার, অভিনেতা-অভিনেত্রীর অঙ্গ সঞ্চালন এবং সংগীতের প্রয়োগ করে এই প্রযোজনা দুটি নতুন এক চিন্তার উদ্রেক করে। এই অচলায়তনও মঞ্চসজ্জা, কস্টিউম, আলোর ব্যবহার মিলিয়ে এমন কিছু নাট্যমুহূর্তের সৃষ্টি করে, যা আমাদের সেরিব্রাল সিস্টেমে খুব সহজে একটা নতুন আলোড়নের সৃষ্টি করে।

‘অচলায়তন’ নাটকের দৃশ্য। ছবি: প্রাচ্যনাটের সৌজন্যে

আমাদের অতীতের নাটকে যে রত্ন লুকিয়ে আছে, তাকে আবিষ্কার করার দায়িত্ব আমাদের অবশ্যই আছে। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, কারিগরি দিকগুলোও সংকুচিত, দর্শকদেরও নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও আমাদের সাধ্যে তা কুলায় না। প্রাচ্যনাটের বড় সম্পদ সংগীত, নৃত্য দেহভঙ্গিমায় প্রশিক্ষিত একদল সুশিক্ষিত নাট্যকর্মী। সেই সঙ্গে শিল্পনির্দেশনার নবতর চিন্তায় অগ্রণী শিল্পীরা। সবটা মিলিয়ে অচলায়তন যে নতুন অভিজ্ঞতা দেয়, আশা করব দর্শকও সেটি উপভোগ করবেন।
মামুনুর রশীদ। নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা