জমি বন্ধক রেখে কাজলাকান্দা গ্রামের নোলককে ঘরে তুলে আনে সয়ফর। বাসরঘরে নববধূকে বলে, ‘আপনার লেগা পাগল হইছি, রক্ত বেচেও যদি বিয়া করা লাগত, করতাম।’
পাশের গ্রামে যাত্রা দেখতে গিয়ে নোলককে প্রথম দেখে সয়ফর, সেই থেকে তার পাগলপারা দশা। ‘সয়ফর’ ও ‘নোলক’ চরিত্রে অভিনয় করছেন শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী। সয়ফর ও নোলকের মতো তাঁরাও ভালোবেসে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, প্রায় তিন দশক ধরে সংসার করছেন এ দম্পতি।
প্রায় দুই দশক পর সেলিম আল দীনের পাঁচালি নাটক প্রাচ্য মঞ্চে নিয়ে আসছে ঢাকা থিয়েটার। দলটির সুবর্ণজয়ন্তীতে ২৮ ও ২৯ জুলাই ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় নাটকটির প্রদর্শনী হবে। নাটকটির নির্দেশনা দিচ্ছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
প্রায় দুই মাস ধরে নাটকটির মহড়া চলছে। প্রদর্শনীর বাকি আর দিন তিনেক, তাই গত রোববার রাত ৯টায় ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে গিয়ে দেখা গেল, শেষ মুহূর্তের মহড়ায় শিল্পীদের দম ফেলার ফুরসত নেই।
দুই দশকের বিরতির পর সয়ফরকে ধারণ করা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তা জানতে চাইলে শহীদুজ্জামান সেলিম বলেন, ‘চরিত্রটি দুই দশক পর করছি, তবে এর ভেতর মঞ্চে নিয়মিতই কাজ করেছি। তবে সয়ফর চরিত্রটির জন্য আমাকে চর্চা করতে হচ্ছে।’
শুধু সেলিম–রোজীই নন, এই নাটকে কাজ করছেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ–শিমূল ইউসুফ, ফারুক আহমেদ–নাসরিন নাহার দম্পতিও। প্রাচ্যর সূত্রধর হিসেবে মঞ্চে থাকছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী শিমূল ইউসুফ আর নাটকটির নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ। সেলিম নাটকে রোজীকে স্ত্রী হিসেবে পেলেও ফারুক পাননি। সেলিমের দাদির চরিত্রে থাকছেন ফারুকের স্ত্রী নাসরিন; সেলিমের দাদা নেই।
সয়ফরের বন্ধু ‘সুরত আলী’ চরিত্রে অভিনয় করছেন ফারুক আহমেদ; নাসরিন নাহারকে ‘দাদি’ বলে সম্বোধন করছেন ফারুক। প্রাচ্য নাটকেই শেষবার একসঙ্গে কাজ করেছেন এ জুটি, দুই দশক পর একসঙ্গেই মঞ্চে ফিরলেন তাঁরা। সুরত আলীর সংলাপ ভুলে গিয়েছিলেন ফারুক, তিন–চার দিনের চেষ্টায় সংলাপ মুখস্থ করেছেন তিনি।
শিমূল ইউসুফ, শহীদুজ্জামান সেলিম, রোজী সিদ্দিকী, ফারুক আহমেদ, নাসরিন নাহারসহ নাটকটির ৭০ ভাগের মতো শিল্পী পুরোনো চরিত্রেই ফিরছেন। অল্প কয়েকজন নতুন শিল্পীকে নেওয়া হয়েছে।
গত পঞ্চাশ বছরে কিত্তনখোলা, শকুন্তলা, হাতহদাই, যৈবতী কন্যার মন, চাকা, বনপাংশুল, বিনোদিনী, নিমজ্জন, চাকা, ধাবমান–এর মতো অনেক আলোচিত নাটক মঞ্চে এনেছে ঢাকা থিয়েটার। সুবর্ণজয়ন্তীর উদ্বোধনী আয়োজনে সব ছাপিয়ে প্রাচ্যকেই বেছে নেওয়া হলো কেন? গতকাল সকালে নাসির উদ্দীন ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাটকটি একটু জটিল। ৫০ বছর পূর্তিতে আমরা সবচেয়ে জটিল নাটকটিই করছি। নাটকটি ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধিত্ব করে।’
সেলিম আল দীনের জীবদ্দশায় ২০০০ সালে মঞ্চে প্রথম প্রাচ্য করে ঢাকা থিয়েটার, বছর তিনেক নিয়মিত প্রদর্শনীর পর নাটকটি আর মঞ্চে আনা হয়নি। সেলিম আল দীনের মৃত্যুর পর এবারই প্রথম নাটকটি মঞ্চে তুলছে ঢাকা থিয়েটার।
প্রাচ্য এত দিন মঞ্চে ছিল না কেন? নাসির উদ্দীন ইউসুফের ভাষ্য, নাটকটির জন্য মঞ্চের একটি কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছিল। কাঠের তৈরি কাঠামোটি বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যায়। বেশ ব্যয়বহুল বলে সেটি আর পরে বানানো হয়নি। শিল্পীদের মধ্যে অনেককেই তখন পাওয়া যায়নি। নাটকটির প্রযোজনার দিকটাও জটিল, প্রচুর মহড়া করতে হয়। সব মিলিয়ে করা যায়নি।
প্রাচ্য পাঁচালি নাটক। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘এই কাঠামোর ওপর আধুনিক বাংলা নাটক গড়ে উঠতে পারে। ঔপনিবেশিক নাট্যরীতির বিপরীতে বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতির আঙ্গিক অনুসন্ধানে ব্রতী হয়ে যেসব কাজ হয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি। নাটকটি আমাদের নাট্যরীতির প্রতিনিধিত্ব করে।’
দুই দশক আগের প্রদর্শনীর কোনো ভিডিও ধরে রাখা হয়নি, তবে কিছু ছবি তোলা ছিল। সেই ছবি আর স্মৃতির ওপর ভর করেই প্রাচ্যর দৃশ্য নির্মাণ করছেন নির্দেশক। মহড়ার এক দৃশ্যে দেখা গেল, মৃত্যুশয্যায় জিতু মাতব্বরের কফিনটা দুই দশক আগে কেমন ছিল, সেটা নিয়ে সংশয়ে নির্দেশক। স্মৃতি হাতড়ে দুই দশক আগে ফেরার চেষ্টা করছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। তিনি বলেন, অনেক কিছুই স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। আবার কিছু মুছে গেছে, সেগুলো নতুন করে করতে হচ্ছে। কিছু ব্যাপারে দ্বিধা তৈরি হচ্ছে।
দুই দশক আগের নকশার পোশাক কিছুতেই মিলছে না, পোশাকের নকশায় তাই খানিকটা পরিবর্তন আনা হচ্ছে। মঞ্চে আলোক প্রক্ষেপণে খানিকটা আধুনিকতার ছাপ থাকবে। আর মঞ্চের কাঠামোটা এবার কাঠ নয়, লোহার রড দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
১৯৭৩ সালের ২৯ জুলাই গঠিত ঢাকা থিয়েটারের প্রথম নাটক সংবাদ কার্টুন মঞ্চে এসেছিল একই বছর নভেম্বর মাসে। নাট্যদলটির সুবর্ণজয়ন্তীতে ২৮ জুলাই বিকেল ৫টায় শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করা হবে। উপস্থিত থাকবেন রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, মামুনুর রশীদ, ম. হামিদ ও সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকী। সাড়ে পাঁচটায় থাকছে ‘প্রাচ্য ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ’ শীর্ষক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। ২৮ ও ২৯ জুলাই সন্ধ্যা সাতটায় থাকছে প্রাচ্যর প্রদর্শনী।
বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহায়তায় প্রতিবন্ধী নাট্য উৎসব, সেমিনারসহ নানা আয়োজন রয়েছে। আগামী বছরের মার্চের দিকে নতুন ও পুরোনো নাটক নিয়ে একটি নাট্য উৎসব করবে ঢাকা থিয়েটার।