জুহুর পৃথ্বী থিয়েটারে ‘দ্য ফাদার’ চলছে। নাসিরুদ্দিন শাহর অভিনয়ের কথা খুব শোনা যাচ্ছে। মুম্বাই এসে এই নাটক না দেখে কি ফেরা যায়! কিন্তু টিকিট কি মিলবে? মূলত অনলাইনেই সবাই টিকিট কাটে। দ্বিধা নিয়েই বেরিয়ে পড়ি। সারা দিনই বৃষ্টি—সন্ধ্যা থেকে আরও বেড়ে গেছে। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে গিয়ে দেখি নোটিশ বোর্ডে ‘হাউসফুল’ ঝুলছে। আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, এমন সময় কাকতালীয়ভাবে দুটি টিকিট মিলে যায়!
জুহু এলাকার এক সরু গলিতে বিখ্যাত কাপুর পরিবারের বাড়ির আঙিনায় এই পৃথ্বী থিয়েটার। মূল সড়ক থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে আবাসিক এলাকায় এমন ছিমছাম স্থাপনা আছে। এক আঙিনায় নাটকের মিলনায়তন, বই এবং খাবারের দোকান। সকাল, সন্ধ্যা সারাক্ষণই আড্ডা চলছে। তবে হইহট্টগোল নেই। কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পৃথ্বীরাজ কাপুরের নামকে ধারণ করে এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে বছরের পর বছর। মুঘল ই আজমের কল্যাণে সাধারণ দর্শকের কাছে পৃথ্বীরাজ কাপুর ‘আকবর’। ভারতীয় আধুনিক থিয়েটারচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ।
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পৃথ্বী থিয়েটার। অবশ্য সেটি ছিল মূলত নাটকের দল, সারা ভারত ঘুরে ঘুরে নাটক করতেন তাঁরা। পৃথ্বীরাজ কাপুরকে স্মরণ করে ১৯৭৮ সালে ছেলে শশী কাপুর এবং তাঁর স্ত্রী জেনিফার কাপুর মিলে প্রতিষ্ঠা করেন বর্তমান পৃথ্বী থিয়েটার। শুরু থেকেই এটি হয়ে ওঠে সাধারণের সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম কেন্দ্র আর বলিউড তারকাদের আড্ডার জায়গা।
এক বাবার গল্প
লাইন ধরে ঢুকে পড়লাম। অপরিসর মিলনায়তনে তিন পাশে দর্শক, এক পাশে মঞ্চ। সেখানে আলোতে উজ্জ্বল স্বয়ং নাসিরুদ্দিন শাহ। যথাসময়ে শুরু হয় দ্য ফাদার। অভিনয়, সংলাপ, শব্দ, আলোর অসাধারণ খেলায় কখন যে সময় চলে যায়, টের পাই না। এই ফাঁকে বলে রাখি, ফ্লোরিয়ান জেলারের এই নাটক থেকে হলিউডে চলচ্চিত্রও হয়েছে। যে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ২০২১ সালের অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন অ্যান্থনি হপকিন্স। নাটকে অ্যান্থনি হপকিন্সের চরিত্রটাই করেছেন নাসিরুদ্দিন শাহ।
গল্পটা হৃদয়স্পর্শী। অশীতিপর এক বাবা আর তাঁর সন্তানের কথোপকথন আর নানান কর্মকাণ্ডে এগিয়ে যায় নাটক। বাবাটি বয়সের কাছে পরাজিত সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তা। বয়স তাঁকে নিয়ে গেছে আলঝেইমার আর ডিমেনশিয়ার কাছে। অতীতটাকেই বর্তমান মনে করেন। নিজেকে মনে করেন ছোট্ট শিশুর বাবা। আবার কখনো কখনো মেয়ের সস্নেহ শাসনে বিচলিত হন, ভুলে যান কোথায় আছেন, কোথায় যাবেন।মেয়েকে নিয়ে তাঁর রাজ্যের চিন্তা।
আশপাশের মানুষ নিয়ে তাঁর নানা রকমের দুশ্চিন্তা, অবিশ্বাস। নাটকের শেষ দৃশ্যে এসে দর্শক আবিষ্কার করেন, পুরো বিষয়টা ছিল বৃদ্ধের অবচেতন মনের কল্পনা। হাসপাতালের বিছানায় বর্তমানে অতীত নিয়ে আছেন তিনি।
দর্শকসারিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই পর্দার চেনামুখ। ছিলেন বলিউড তারকা রাধিকা আপ্তে। তাঁদের কারও মধ্যেই তারকাসুলভ কোনো ভাব ছিল না, দর্শকেরও বাড়তি আগ্রহ ছিল না তাঁদের প্রতি। বরং সবার আগ্রহ ‘স্যার নাসিরুদ্দিন’–এর প্রতি।
দেড় ঘণ্টার নাটক। মিলনায়তনের প্রতিটি আসন ছিল পূর্ণ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁরা দেখেছেন অভিনয়। বিশেষ করে নাসিরুদ্দিন শাহর অভিনয়। যদিও সবাই সমানতালে অভিনয় করেছেন। সবাই বলিউড কিংবা টেলিভিশন পর্দার পরিচিত মুখ। নাটক শেষে দর্শকের সঙ্গে অন্য অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের পরিচয় করিয়ে দেন নাসিরুদ্দিন শাহ। মুর্হুমুর্হ করতালি দিয়ে তাঁদের অভিনন্দিত করেন দর্শক। বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবিষ্কার করি, অন্ধকার দর্শকসারিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগই পর্দার চেনামুখ। ছিলেন বলিউড তারকা রাধিকা আপ্তে। তাঁদের কারও মধ্যেই তারকাসুলভ কোনো ভাব ছিল না, দর্শকেরও বাড়তি আগ্রহ ছিল না তাঁদের প্রতি। বরং সবার আগ্রহ ‘স্যার নাসিরুদ্দিন’–এর প্রতি।
নাসিরুদ্দিন শাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ
নাটক শুরুর আগেই অনুরোধ করা হয়েছিল, নাটকের মধ্যে বা নাটক শেষে কস্টিউম পরা অবস্থার ছবি যেন কেউ না তোলেন। নাটক শেষে ভেতরে গিয়ে আলাপ করা যাবে, সময় দেবেন নাসিরুদ্দিন। এ সুযোগ কে হারায়? চলে গেলাম ভেতরে। ততক্ষণে কস্টিউম ছেড়ে ফুরফুরে মেজাজে শিল্পী। এই বলিউড তারকা জানালেন, মঞ্চে নিজেকে যতটা সাবলীল এবং সুখী মনে হয়, অন্য কোথাও তেমন নয়। এটা আজকের না, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই।
১৯৭১ সালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করে ভর্তি হয়েছিলেন দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায়। আর্থিক নিরাপত্তা পেতে চলচ্চিত্র বা অন্য মাধ্যমে কাজ করলেও মঞ্চই তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
প্রায় প্রতিদিনই ‘দ্য ফাদার’–এর প্রদর্শনী আছে, তাই পুরো সেপ্টেম্বরই বাইরের কাজ তেমন একটা রাখেননি। কোনো কোনো দিন পরপর দুটি প্রদর্শনীও আছে। ‘মোল্টে প্রডাকশন’ প্রযোজিত নাটকটিতে আরও কাজ করেছেন তাঁর স্ত্রী রত্না পাঠক শাহ, কন্যা হেবা শাহ, অভিনেতা সায়ন মুখার্জি, ফয়সাল রশিদ, নিরাজ কবি প্রমুখ।
নিজের নির্দেশিত নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় প্রসঙ্গে নাসিরুদ্দিন শাহ জানালেন, বাস্তব জীবনেও মাঝেমধ্যে নিজেকে নাটকের চরিত্রটির অবস্থানে আবিষ্কার করেন। তিনি নিজে ‘ওনোমাটোম্যানিয়া’ নামের এক স্নায়ু রোগে আক্রান্ত। কিছু শব্দ, বাক্য বারবার বলা অভ্যাস।
নাসিরুদ্দিন বলেন, ‘সব সময় আমি এমনটা করি, কখনই শতভাগ বিশ্রাম নিতে পারি না। এমনকি যখন ঘুমাচ্ছি, তখনো পছন্দের কোনো কাজ করছি। ভাবতে পারেন!’ প্রসঙ্গের বাইরে আরেকটি বিষয়ে চলে যাই, বলিউডে তো বর্জন–ঝড় বইছে...। বাক্য শেষ করতে দেন না, বলে ওঠেন, এসব করে তো ইন্ডাস্ট্রিকেই ধ্বংস করছে। নিজের পায়ে কুড়াল মারছে!
যখন ফিরছি, দেখি বৃষ্টিভেজা রাতে হনহন করে মূল সড়কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন রাধিকা আপ্তে, হয়তো সেখানেই আছে তাঁর গাড়ি। আচ্ছা, আমাদের দেশের বড় পর্দার তারকা শিল্পীদের কেন দেখা যায় না নাটকপাড়ায়, টিকিট কেটে দর্শকসারিতে বসে নাটক দেখতে!