‘কাউন্টারে কোনো টিকিট রাখতে পারছি না। আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’ গত ১২ জুন ফেসবুকে পেজে এই ঘোষণা দেয় নাট্যদল তাড়ুয়া। দলের আদম সুরত নাটকের সেই দিনের প্রদর্শনীর সব টিকিট মুঠোফোনেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
আলী যাকের নতুনের উৎসবে ২৫ জানুয়ারি মঞ্চে আসার পর এ পর্যন্ত নাটকটির আটটি প্রদর্শনী হয়েছে। নাটকের নির্দেশক বাকার বকুল ২২ জুন মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানান, এর মধ্যে অন্তত দুটি প্রদর্শনীর টিকিট কাউন্টারে দিতেই পারেননি তাঁরা। বাকি ছয়টি প্রদর্শনীর ৯০ ভাগের বেশি টিকিট মুঠোফোনে বিক্রি করেছেন, ১০ ভাগের কম টিকিট কাউন্টারে মিলেছে।
বছর পাঁচেক আগেও ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতির টিকিটঘরের সামনে দর্শকের ভিড়ভাট্টা ছিল চোখে পড়ার মতো। দেশে মোবাইল ব্যাংকিং চালু হওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে ফোনে ফোনে দুয়েকটি নাটকের টিকিট বিক্রির খবর মিলতে থাকে। আর করোনার পর থেকে টিকিটঘরের সামনে ভিড় কমতে থাকে। ঘরে বসে মুঠোফোনেই টিকিট কেনার দিকে ঝুঁকে পড়েন মঞ্চনাটকের দর্শকেরা।
গত জুন মাসে ‘আদম সুরত’ ছাড়া শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতিতে মঞ্চস্থ হয়েছে স্পর্ধার ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’, হৃৎমঞ্চের ‘রিমান্ড’, বাতিঘরের ‘ভগবান পালিয়ে গেছে’, থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ ইত্যাদি; মে মাসে এসেছে থিয়েটারের নতুন নাটক ‘লাভ লেটারস’।
১৫ জুন থেকে টানা ১৫ দিনে শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র ২১টি প্রদর্শনী হয়েছে। ২১টি প্রদর্শনীর মধ্যে অন্তত ১১টি প্রদর্শনীর শতভাগ টিকিটই মুঠোফোনে বিক্রি হয়েছে। ফলে সেসব দিনে টিকিট২ঘর কার্যত বন্ধই ছিল বলে জানিয়েছে স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেকটিভ।
দর্শক কীভাবে মুঠোফোনে টিকিট কাটেন, তার খানিকটা ধারণা দিলেন স্পর্ধার কর্মী সুস্মিতা খান। সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া নির্দিষ্ট নম্বরে যোগাযোগ করে নিজের নাম ও টিকিটের ক্যাটাগরি লিখে পাঠান দর্শক। সেই ক্যাটাগরির টিকিট সহজলভ্য হলে দর্শককে জানানো হয়। এরপর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টিকিটের মূল্য পরিশোধ করলে টিকিটটি ‘বুক’ করা হয়; প্রদর্শনীর আগে স্পর্ধার কর্মীদের কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করেন দর্শক।
১৫ জুন নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী দেখেছেন ধানমন্ডি থেকে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী মনির হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিবার নিয়ে ঢাকার যানজট ঠেলে শিল্পকলায় এসে টিকিট না পেলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর মুঠোফোনে টিকিট কাটলে সময় বাঁচে, নিশ্চিতও থাকা যায়।
দর্শকের পাশাপাশি নাট্যদলও টিকিটঘরে টিকিট বিক্রির ঝামেলা থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত। থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা রামেন্দু মজুমদার জানান, ‘লাভ লেটারস’ নাটকের ৯০ ভাগের বেশি টিকিট মুঠোফোনে বিক্রি করেছে থিয়েটার। তাঁর ভাষ্যে, প্রযুক্তির মাধ্যমে অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে নাট্যদলগুলো আগেভাগেই অর্থ পাচ্ছে, আবার কতজন দর্শক আসবেন, সেটাও আগেভাগেই জানতে পারছেন।’
মুঠোফোনে টিকিট কাটার চল আসার আগেও টুকটাক অগ্রিম টিকিট বিক্রি হতো, বেইলি রোডের বিভিন্ন দোকানে টিকিট রাখা থাকত, তবে বেচাবিক্রি ছিল সীমিত। দিন শেষে দর্শক প্রদর্শনীর আগেই কাউন্টার থেকে টিকিট কিনতেন বলে জানান রামেন্দু মজুমদার।
ঢাকার মঞ্চে ১৯৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বাদল সরকার রচিত নাটক ‘বাকি ইতিহাস’–এর প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো টিকিট বিক্রি করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। এর পর থেকে নিয়মিতভাবে টিকিট কেটে মঞ্চে নাটক উপভোগ করছেন দর্শক। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেটেও মাঝেমধ্যে নাটকের প্রদর্শনীর খবর মেলে।
অনলাইনে টিকিট মিলবে কবে
বাংলাদেশের মতো ভারতেও একসময় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মঞ্চনাটকের টিকিট কেনায় ঝুঁকে পড়েন দর্শক। শূন্য দশকের শেষ ভাগে সিনেমার টিকিট বিক্রির জন্য দেশটিতে বুকমাইশো ডটকম নামে একটি প্ল্যাটফর্ম যাত্রা করে। বর্তমানে এই প্ল্যাটফর্মে কলকাতাসহ ৬৫০টির মতো শহরে সিনেমার পাশাপাশি মঞ্চনাটকেরও টিকিট মেলে।
বাংলাদেশে সিনেমা ও কনসার্টের টিকিটের জন্য এমন প্ল্যাটফর্ম থাকলেও মঞ্চনাটকের জন্য নেই বললেই চলে। ঢাকার দুয়েকটি নাট্যদল নিজেদের ওয়েবসাইটে নিজেদের প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রি করে। ঢাকার সব নাটকের টিকিট একই প্ল্যাটফর্মের আওতায় বিক্রি করা গেলে দর্শক আরও বাড়বে বলে মনে করছেন নাট্যকর্মীরা।
মাস দুয়েক আগে পরীক্ষামূলকভাবে ট্র্যাকমাইশো ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট চালু করেছে নাট্যদল তাড়ুয়া। এতে নিজেদের নাটক আদম সুরত ছাড়া থিয়েটারওয়ালা রেপার্টরির নাজুক মানুষের সংলাপ নাটকের টিকিটও বিক্রি করা হয়েছে।
নাট্যদলটি জানিয়েছে, সংখ্যায় কম হলেও দর্শক ওয়েবসাইট থেকেও টিকিট কিনছেন। আরও কয়েকটি নাট্যদলের সঙ্গে আলোচনা চলছে, যেকোনো নাট্যদলের ভালো নাটকের টিকিট বিক্রিতে যুক্ত থাকতে চায় তারা।