চারপাশে দর্শক। মাঝখানে মঞ্চ। মঞ্চের দুই পাশে বসেছে যন্ত্রশিল্পীরা। একসময় শোনা গেল নানা বাদ্যযন্ত্রের সুর। বাঁশি, ঢোল, করতালের আওয়াজের সঙ্গে শিল্পীর উচ্চকণ্ঠের ময়দান কাঁপানো সংলাপে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ খেলে যায় দর্শক-শ্রোতাদের মনে। মুহুর্মুহু করতালির শিল্পকলা একাডেমি চত্বর প্রতিধ্বনিত হয় যাত্রার প্রতি দর্শকদের ভালো লাগা ও ভালোবাসার কথা। দর্শকের উল্লাসে কুশীলবেরাও যেন নতুন করে প্রাণ পান এবং অনুপ্রাণিত হন অভিনয়ে।
দেশের ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনাশিল্প যাত্রাকে বেশ কয়েক বছর ধরেই টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অতীতে এই শিল্পের যে বিত্তবৈভব ছিল, তা এখন ম্রিয়মাণ। প্রশাসনিক অনুমতির বিড়ম্বনা, শিল্পীদের উপযুক্ত সম্মানী না পাওয়া, ভাড়াটে শিল্পীদের অশ্লীল নৃত্য পরিবেশনাসহ নানা জটিলতায় ধুঁকছে যাত্রাশিল্প। সেই প্রেক্ষাপটে যাত্রাপালার গতি সঞ্চারে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। সেই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে একাডেমির আয়োজনে বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হলো গণজাগরণের যাত্রাপালা উৎসব।
২০ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান ১৯ দিনব্যাপী এ উৎসবে অংশ নিচ্ছে সারা দেশের ১২০টি যাত্রাদল। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের ৪২টি জেলায় বিভিন্ন বিষয়নির্ভর পালা পরিবেশন করবে এই যাত্রাদলগুলো। প্রথম পর্বে বৃহস্পতিবার থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে উপস্থাপিত হবে ঢাকা বিভাগের ১৫টি দলের যাত্রাপালা। প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী উন্মুক্ত থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য।
শিল্প-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ সৃজনশীল ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় শিল্প নিয়ে পৌঁছে যাব আমরা উন্নতির শিখরে’ প্রতিপাদ্যে ‘গণজাগরণের শিল্প আন্দোলন’ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে একাডেমি। দেশব্যাপী শিল্পযজ্ঞ পরিচালনার সে উদ্যোগের অংশ হিসেবে যাত্রাশিল্পের জাগরণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ উৎসব।
কার্তিকের হালকা হিম সন্ধ্যায় উৎসবের সূচনা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী।
উদ্বোধনী আলোচনায় বক্তারা বলেন, দেশজ ঐতিহ্যের সঙ্গে মূল্যবোধকে ধারণ করেই যাত্রাপালার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। সে কারণে আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকসংস্কৃতির অন্যতম শাখা যাত্রাপালা বরাবরই গণমানুষের সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত। তাই তৃণমূল মানুষের প্রিয় শিল্পমাধ্যমটিকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। পালা পরিবেশনায় জেলা প্রশাসনের অনুমতিজনিত জটিলতা দূর করা হবে। পালার মধ্যে ভাড়াটে ড্যান্সারদের অশ্লীলতা বন্ধ করা হবে। এভাবে সংকট উত্তরণের মাধ্যমে যাত্রাপালার পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। সেই পুনর্জাগরণের পথরেখায় আগামী বছর ৬৪ জেলা এবং ৪৯২ উপজেলায় এই উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। যাত্রাপালা ফিরে পাবে তার হারানো জৌলুশ।
উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে লোকনাট্য গোষ্ঠী উপস্থাপন করে যাত্রাপালা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। যাত্রাদল জ্যোতি অপেরা পরিবেশন করে যাত্রাপালা ‘জননীর স্বপ্নপূরণ’ এবং যাত্রাদল বাংলার বাণী অপেরা পরিবেশন করে যাত্রাপালা ‘জাগো মানুষ জাগাও দেশ’ ।
আজ শুক্রবার উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এদিন যাত্রাদল স্বাধীন বাংলা নাট্য গোষ্ঠী পরিবেশন করবে যাত্রাপালা ‘আলোর পথে’। যাত্রাদল মহানগর পরিবেশন করবে যাত্রাপালা ‘দবির দফাদার’ এবং যাত্রাদল শিখা নাট্য গোষ্ঠী পরিবেশন করবে যাত্রাপালা ‘বদলে যাওয়া বাংলাদেশ’। শনিবার যাত্রাদল প্রগতি নাট্য সংস্থার পরিবেশনায় থাকবে যাত্রাপালা ‘একজন রহিমুদ্দি’; যাত্রাদল নিউ লোকনাথ অপেরা পরিবেশন করবে যাত্রাপালা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ’ এবং যাত্রাদল বন্ধু অপেরা পরিবেশন করবে যাত্রাপালা ‘বদলে যাওয়া বাংলাদেশ’।