আজ থেকে ৩৬ বছর আগে, ১৩৯৫ বঙ্গাব্দের ২৬ মাঘ ‘দৈনিক ইত্তেফাকে’র পাতায় একটি খুদে ইনসারশন বেরিয়েছিল। কলকাতার অন্য থিয়েটার লিখেছিল- ‘আরণ্যক নাট্যদলের আমন্ত্রণে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র সাতটি জনসংবর্ধিত অভিনয়ের শেষে আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি বাংলাদেশ সফরের সুখস্মৃতি নিয়ে। এখানকার অগণিত দর্শক ও নাট্যকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া অকুণ্ঠ ভালোবাসায় আমরা কৃতজ্ঞ।’
ওই ‘অকুণ্ঠ ভালোবাসা’ কীভাবে বাংলাদেশের মঞ্চনাটককে অনুপ্রাণিত করেছিল তার সাক্ষী ১৯৯০–এর দশক। ঢাকা তো বটেই, কুমিল্লা–খুলনার মতো জেলা শহরেও ময়মনসিংহের নানান গীতিকা অনুসরণে নাটক করার বান ডাকে। সেই বান এখনো মিলিয়ে যায়নি। ‘সোনাই মাধব’ ‘চন্দ্রাবতী কথা’ কিংবা ‘চম্পাবতী’ ‘মহুয়া’ ‘মলুয়া’র মতো প্রযোজনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের একাংশ আজও নিজস্ব নাট্যঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নগরনাট্যের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কাঠামো কিংবা ইউরোপিয়ান তরিকা থেকে সরে না এসেও লোকায়ত কিস্সা-কাহিনির আধুনিক অভিযোজন ঘটানোর এই গরজ ইতিমধ্যে একটি ঘরানা তৈরি করেছে। এই ঘরানায় নতুন সংযোজন থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘মাধব মালঞ্চী’।
গত ৫ জুলাই, ঢাকায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় ‘মাধব মালঞ্চী’র একটি মহড়া দেখেছিলাম। মজা পেয়েছিলাম, মজে যাইনি। ১৭ ফেব্রুয়ারি, কলকাতার তপন থিয়েটারে অনীকের গঙ্গা-যমুনা নাট্য উৎসবে ‘মাধব মালঞ্চী’র দশম মঞ্চায়ন দেখতে গিয়ে মজে যাওয়ার অনুভব হলো।
মনে মনে নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবীকে সালাম দিলাম। নকলনবিশি নয়, নগর নাট্যের স্মৃতিপটে দাগ কেটে যাওয়া একটি নাটককে একেবারে আনকোরা মেজাজে মঞ্চে ফেরানোর মধ্যে বাহাদুরি আছে। দেখলাম কীভাবে সংগীত পরিচালক সেলিম মাহবুব আর মঞ্চ-আলোক পরিকল্পক জুনায়েদ ইউসুফের যোগ্য মদদ ষোলো আনা উশুল করলেন নির্দেশক। সংগীতময় নাট্যপ্রয়োগের যে পরম্পরা থিয়েটার আর্ট ইউনিট বয়ে চলেছে, তার স্রোতে মনপবনের নাও ভাসানোর মুরোদ দেখাল তাদের ৩৬তম প্রযোজনা।
‘মাধব মালঞ্চী’র আখ্যানে বড় কোনো অভিনবত্ব নেই। লোকায়ত কথা ও কাহিনির যে ধাঁচা দুনিয়াজুড়ে কায়েম আছে, যে ধাঁচায় কিং আর্থারের বিলেতি গল্পের খেই ধরে রূপভান কইন্যার গাথা, এখানেও তা বহাল। মাধব (ঐতিহ্য, মেহবুদ সিদ্দীকি লেলিন) এক ভাগ্যতাড়িত রাজার কুমার। রাজা-রানির মৃত্যুর পর দাদাদের হাতে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। বরাত জোরে আশ্রয় পেয়েছে বলরাজার (সুজন রেজাউল) দেশে।
লেখাপড়ায় মন দিয়েছে। শুধু কি তা–ই? সে দেশের রাজকন্যা মালঞ্চীর (ইন্দ্রাণী ঘটক) সঙ্গে মন দেওয়া–নেওয়া হয়েছে মাধবের। তাই বলে কি আর অজ্ঞাতকুলশীল মাধবের সঙ্গে মালঞ্চীর বিয়ে দেওয়া চলে? চলে না।
বলরাজা মেয়ের জন্য রাজবংশীয় পাত্র জোগাড় করলেন। মাধব-মালঞ্চী যুক্তি করল। নানান অলৌকিক কাণ্ডকারখানার দৌলতে পাওয়া মনপবনের নাও বেয়ে গুড়গুড়িগাছের নিচে মালঞ্চীর অপেক্ষায় রইল মাধব। হায় রে বিধি!
বিয়েবাড়ির হইহট্টগোল এড়িয়ে নদীর ধারে আসতে দেরি হলো মালঞ্চীর। তাতেই গোল পাকাল। দেখাই হলো না দুজনের। শেষটায় দুস্তর বাধা পেরিয়ে, সেপাই সেজে, টাট্টু ঘোড়া হাঁকিয়ে, বুইট্যাল রাজার (মোকাদ্দেম মোরশেদ) দেশে এসে খতরনাক রাক্ষস মেরে মালঞ্চীর দেখা পেল মাধব। দুজনে দেখা হলো। মাধব বললে, ‘ছিপাই গো-দুঃখের কথা কী কইবাম? আমি এক কইন্যারে চিনতাম, ঠিক আপনের মুহের লাহান তার মুখ।’ কপাল চাপড়ে মালঞ্চী বললে, ‘আমি তুমারে আগেই চিনছি-আর তুমি অহনও আমারে চিনতারলা না?’
বিভাস চক্রবর্তীর নাট্যরূপ থেকে বড় একটা সরে যাননি রোকেয়া রফিক বেবী। সিলেটি বাংলার ওই সহজ চলনকে এমনভাবে বাহন করেছেন যে ঢাকা-কলকাতা কারোর কান কটকট করেনি। রূপকথার মোড়ক ছাড়িয়ে ‘মাধব মালঞ্চী’র মধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের একটি বয়ান খুঁজে নিয়েছিলেন বিভাস। রোকেয়া সেটিকে বিস্তার দিয়েছেন। ঢাকার দর্শকের অভ্যেস মাফিক দেড় ঘণ্টার মধ্যে নাটক বাঁধার তাগিদ থেকে একটু ছেঁটে–কেটে নিয়েছেন এই যা! এমন নাটকের চলন আর পাঁচটা রিয়েলিস্টিক নাটক থেকে আলাদা হওয়ার কথা। তাই হয়েছে। অভিনয়ের ধরনে সুরেলা আদল এসেছে। সংলাপের জায়গা নিয়েছে সংগীত। কতক পালাগানের অনুসরণে প্রসেনিয়ামের এক ধারে উইংসের পাশে বসে গান গেয়ে বাদ্যি বাজিয়ে নাটক জমিয়েছেন সেলিম মাহবুবের দলবল। সূত্রধর নুরুজ্জামান বাবু তুখোড় নট। গলাও সুরে চলে। তাঁকে নাটকের মধ্যে গেঁথে দিয়েছেন রোকেয়া। কিস্সা শোনানোর বাহানায় কুশীলবও হয়ে উঠেছেন তিনি।
মাধব আর মালঞ্চীর দুই চরিত্রাভিনেতা নিজেদের গান নিজেরাই গাইলে সোনায় সোহাগা হতো। মালঞ্চীর ভূমিকায় ইন্দ্রাণী চোখেমুখে কথা বলেন, ক্ষিপ্র পদক্ষেপে দাপিয়ে বেড়ান মঞ্চে। মাধবের ভূমিকায় লেলিন তুলনায় সাদামাটা হলেও বেমানান লাগে না তাঁকে। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের কুশীলবদের একজনকেও খাপছাড়া লাগে না। পোড় খাওয়াদের মধ্যে অভিব্যক্তির সূক্ষ্ম কারিকুরিতে দাগ কেটে যান সুজন রেজাউল, নাহিদ সুলতানা লেমন।
আলাদা করে বলতেই হয় জুনায়েদ ইউসুফের কথা। একেবারে হালকা একটি মঞ্চ গড়েছেন জুনায়েদ। যৎসামান্য উপকরণ দরকারমতো কেটে জুড়ে নিয়ে বানিয়ে ফেলেছেন রকমারি স্থাপত্য। চাকাজুড়ে দিয়েছেন মনপবনের নাওয়ের তলায়। আলোর কারসাজি ছাড়াই এত কিছু ঘটিয়ে ফেলার জন্য জুনায়েদ আমাদের বাহবা পাবেন। ঢাকার মঞ্চায়নে নানান ধরনের ফিল্টার ইস্তেমাল করেছিলেন তিনি। কলকাতায় সেসব পেলেন না বোধ হয়। তাতে অবিশ্যি রসহানি তেমন হলো না।
অন্য থিয়েটারের ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’ সেদিনের পশ্চিমবঙ্গের প্রসেনিয়াম থিয়েটারের মরা গাঙে বান এনেছিল। মাতিয়েছিল বাংলাদেশকেও। দিনকাল বদলেছে। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের ‘মাধব মালঞ্চী’ বিষয় বা আঙ্গিকের দিক থেকে নতুন পথের দিশারি না হলেও হারানো বাংলার সহজিয়া মর্মকথাকে নতুন করে উপস্থাপন করে আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হলেন। ফিরে তাকানোর মধ্যে যেসব সময় অলস কালক্ষয় থাকে না, সেটিও মনে করালেন।
শুধু একটি অনুযোগ। বিভাস চক্রবর্তী তাঁর ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র মূলধন আহরণ করেছিলেন ঢাকা থেকে বেরোনো ‘মোমেনশাহী গীতিকা’ (বাংলা একাডেমি, ১৯৭১) থেকে, যার সম্পাদক ছিলেন বদিউজ্জামান আর ক্ষেত্র সমীক্ষক ছিলেন খোদ ময়মনসিংহের জাতক মোহাম্মদ সাইদুর। চন্দ্রকুমার দে-কে বাদ দিয়ে দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২৩) যেমন ভাবা যায় না, তেমনই মোহাম্মদ সাইদুরের মতো তন্নিষ্ঠ সমীক্ষককে বাদ দিলে ‘মাধব মালঞ্চী কইন্যা’র অঙ্গহানি ঘটে। থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনা পুস্তিকার কোথাও মোহাম্মদ সাইদুরের উল্লেখ নেই। এটি জুড়ে দিলে গৌরবে বহুবচনের প্রাচীন প্রবাদটিকেও মান্যতা দেওয়া হবে।
কলকাতা। ৭ ফাল্গুন ১৪২৯ ব/২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩