বাবা, মা ও মেয়ের ‘ম্যাড থেটার’

আসাদুল ইসলাম (ডানে), সোনিয়া হাসান (মাঝখানে) ও আর্য মেঘদূত। সম্পর্কে বাবা, মা আর মেয়ে। তাঁরা পরিচালনা করছেন নাট্যদল ‘ম্যাড থেটার’
ছবি: সংগৃহীত

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। হিটলারের বাহিনী নেদারল্যান্ডস দখল করেছে। ১৯৪২ সালের ৬ জুলাই ফ্রাঙ্ক পরিবার আশ্রয় নেয় সিক্রেট অ্যানেক্সে (গোপন কুঠুরিতে)। পরিবারের ছোট মেয়ে অ্যানা ফ্রাঙ্কের বয়স তখন ১৩। সে সময় নিজের মনের কথাগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখে সে।

১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট, বন্দী জীবনের ৭৬১তম দিনে হিটলারের বাহিনী সিক্রেট অ্যানেক্সের বাসিন্দাদের ধরে নিয়ে যায়। ঠান্ডা আর শ্বাসকষ্টে বন্দিশিবিরে মৃত্যু হয় আনার। শেষ বিকেলের আলোয় স্কার্টে ঢেউ তুলে বোনের হাত ধরে আর বাড়ি ফেরা হয় না তার। এই অ্যানা ফ্রাঙ্কের ভূমিকায় ৬৫ মিনিট মঞ্চে একক অভিনয় করে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখেন আর্য মেঘদূত।

আর্য মেঘদূতের মতোই দর্শক মাতিয়েছেন আসাদুল ইসলাম ও সোনিয়া হাসানও। তাঁরা অভিনয় করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় বিজয়া নাটকে। নাটকটি রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পাঠিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর শতাব্দীপ্রাচীন প্রেমের গল্প নিয়ে। মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের চরিত্রে আছেন আসাদুল ইসলাম আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চরিত্রে সোনিয়া হাসান।

আসাদুল ইসলাম, সোনিয়া হাসান ও আর্য মেঘদূত একই পরিবারের সদস্য। সম্পর্কে বাবা, মা আর মেয়ে। এই পরিবারের সদস্যরা ২০১৫ সাল থেকে ‘ম্যাড থেটার’ নামের একটি থিয়েটার দল পরিচালনা করছেন। আসাদুল ইসলামের রচনা, নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় এ পর্যন্ত অ্যানা ফ্রাঙ্ক, দ্বিতীয় বিজয়ানদ্দিউ নতিম—তিনটি নাটকের ৭৫টি শো হয়েছে। ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দ্বিতীয় বিজয়া নাটকটির মঞ্চায়ন হয়। নাটক তিনটি নিয়ে লন্ডন ও আসামও ঘুরে এসেছে ম্যাড থেটার।

নদ্দিউ নতিম আসলে মতিন উদ্দিনকে উল্টো করে লেখা। মতিন নিজেকে একজন বোকাসোকা কবি ভাবে। সে কমল নামের এক মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে। গৃহশিক্ষকের চাকরি থেকে বরখাস্তও হয়। কমলের কাছ থেকে একটি গোপন কথা জানার পর মতিনকে জীবন দিতে হয়। কী সেই গোপন কথা, তা জানতে হলে দর্শককে নাটকটি দেখতে হবে। হুমায়ূন আহমেদের কে কথা কয় উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি নির্মাণ করা হয়েছে। নাটকে মতিন চরিত্রে আসাদুল ইসলাম, মুনা চরিত্রে সোনিয়া হাসান ও কমল চরিত্রে অভিনয় করেছেন আর্য মেঘদূত।

সম্প্রতি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আসাদুল-সোনিয়া দম্পতির বাসায় কথা হয় ম্যাড থেটার নিয়ে। সুবচন নাট্য সংসদের সদস্য তাঁরা। প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেখানেই। আসাদুল ইসলাম জানান, নিজেদের মতো করে কাজ করার জন্যই ম্যাড থেটারের জন্ম। তিনি বলেন, পরিবারভিত্তিক এ ধরনের থিয়েটার আর আছে বলে জানা নেই তাঁর।

থিয়েটারের এমন নাম প্রসঙ্গে আসাদুল ইসলাম বলেন, মানুষের অবচেতনে একধরনের সূক্ষ্ম পাগলামি কাজ করে। এই পাগলামি ব্যবহার করে কেউ কেউ প্রথাগত যুক্তি-বুদ্ধির দেয়াল ভেঙে নতুন সমীকরণ সামনে দাঁড় করান। নতুন কিছু করার সম্ভাবনা তৈরি করেন। সেই সম্ভাবনাকে থিয়েটারের মাধ্যমে প্রকাশ করার জন্যই ম্যাড থেটারের জন্ম হয়েছে।

আসাদুল ইসলাম একটি ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনজন দিয়েই পুরো নাটকের মঞ্চায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রুপ থিয়েটারে স্বেচ্ছাসেবকেরা কাজ করেন। তবে ম্যাড থেটারের প্রযোজিত নাটকে কারিগরি কাজে অর্থের বিনিময়ে কর্মীদের যুক্ত করা হয়।

ম্যাড থেটার আসলেই পাগলামি কি না, এ প্রশ্নের জবাবে আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘একেকটা শোতে গড়ে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। গড়ে ১০০ টাকায় টিকিট বিক্রি হয়। দর্শক থাকেন ১০০ জনের মতো। মানুষকে হল পর্যন্ত নেওয়াই তো কঠিন। মঞ্চনাটক নিয়ে প্রচারের অভাব আছে, মানুষের মধ্যেও আগ্রহ কম। তাই থিয়েটার নিয়ে আমাদের কর্মকাণ্ডকে পাগলামিই বলা যায়।’

১৯ বছর বয়সী আর্য মেঘদূত মা–বাবার সঙ্গে থিয়েটারেই বড় হয়েছেন। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘মা–বাবা মঞ্চে নাটক করেছেন। আর আমি তাঁদের সঙ্গে সেখানে গিয়ে বিদ্যালয়ের দেওয়া বাড়ির কাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য কাজ করতাম।’

সোনিয়া হাসান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড থিয়েটারে পিএইচডি করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের তিনজনই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত। আগে একসময় মাঠে বা পাড়ায় পাড়ায় নাটক হতো, এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। থিয়েটারে অভিনয় পেশা হিসেবে গড়ে উঠুক, তা-ই চাই।’