বন্ধ হওয়া ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী সাত দিনের মধ্যে ফেরত দেওয়াসহ দিতে শিল্পকলা একাডেমিকে বেশ কিছু বিষয়ে আলটিমেটাম দিয়েছেন বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীরা। জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মিলনায়তন খুলে দেওয়া, একাডেমির পরিষদে আমলানির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি একাডেমি থেকে সাত দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার দাবি তুলেছেন তাঁরা। গতকাল সোমবার শিল্পকলা একাডেমির মেইন গেটের সামনে ‘বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীগণ’–এর ব্যানারে আয়োজিত সমাবেশে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান বটতলার নাট্যনির্দেশক ও অভিনেতা মোহাম্মদ আলী হায়দার।
গত শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় একদল মানুষের বিক্ষোভের পর ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধের ঘটনায় আয়োজন করা হয় এই সমাবেশের। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন নির্দেশক ও নাট্যকার মাসুম রেজা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–নাট্যকার সামিনা লুৎফা ও অভিনেতা–নাট্যনির্দেশক আজাদ আবুল কালাম।
সমাবেশে মোহাম্মদ আলী হায়দার বলেন, ‘থিয়েটারের সংস্কৃতিতে নাটক বন্ধ হওয়া এবং করা উভয়ই অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ বলে গণ্য হয়। বাইরের মানুষ এটা সহজে না–ও বুঝতে পারেন এবং দাবি তুলতেই পারেন, কিন্তু তাঁদের দাবিতে নাটক বন্ধ করে দেওয়া অত্যন্ত গর্হিত কাজ হয়েছে, যার দায় শিল্পকলার।’
দেশ নাটক প্রযোজিত নিত্যপুরাণ নাটকের টিকিট বিক্রি শুরু হয় শনিবার বিকেল থেকে। এরপর সন্ধ্যা ছয়টার দিকে একদল লোক শিল্পকলার গেটের সামনে দেশ নাটকের সদস্য এহসানুল আজিজ বাবুকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক জামিল আহমেদ গিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করলে যথারীতি নাটকের প্রদর্শনী শুরু হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা আবারও সংগঠিত হয়ে নাট্যশালার গেটের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে মহাপরিচালক ‘দেশ নাটকের’ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেন জামিল আহমেদ।
পরদিন সকালে এক ব্রিফিংয়ে জামিল আহমেদ বলেন, দর্শকের ‘নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দেখে তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল, শিল্পকলা একাডেমিও ‘আক্রান্ত হতে পারে’।
বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীদের সমাবেশে মোহাম্মদ আলী হায়দার আরও বলেন, ‘এহসানুল আজিজ বাবুর মতো নাট্যাঙ্গনের বাইরে যাঁর তেমন কোনো পরিচিতিই নেই, তাঁকে নিয়ে এত বড় মব সংঘটিত করা কেবল বাইরের লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। আর সেনাবাহিনীর কারণে যেহেতু সাধারণ নাট্যকর্মীদের প্রবেশাধিকার শিল্পকলায় সীমিত, কাজেই এই পুরো ঘটনায় পতিত প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েও এখনো টিকে থাকা কোনো গ্রুপ বা নতুন করে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কাজ করা অন্য কোনো অংশের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ সমাবেশে নিত্যপুরাণ নাটকের নির্দেশক ও নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটি তদন্ত হওয়া দরকার। দেশ নাটকের যে সদস্যের পোস্টকে ঘিরে এ ঘটনা ঘটেছে, তিনি খুব পরিচিত লোক নন। আন্দোলনের লোকজন তাঁকে চেনেনও না। তাহলে এর পেছনে কারা আছেন? তাঁদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ যথেষ্ট আন্তরিক থেকে নাটকের প্রদর্শনী সম্পন্ন করতে চেষ্টা করেছেন বলেও জানান মাসুম রেজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও নাট্যকার সামিনা লুৎফা বলেন, ‘শিল্পকলাকে সব দায়িত্ব নিয়ে “নিত্যপুরাণ” নাটকের শো করতে দিতে হবে। তাঁরা মিলনায়তন ভাড়া দিয়েছিলেন। তাঁদের নাটক করতে পারেননি।’ জনসাধারণের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে সেনাবাহিনী থাকার কারণে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারছেন না বলেও মনে করেন সামিনা লুৎফা।
অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক আজাদ আবুল কালাম বলেন, ‘শিল্পকলার দায়িত্বে এই নাট্যশালায় তিন দিনের একটি উৎসব করা উচিত এবং শিল্পকলাকে এর সব ব্যয় বহন করতে হবে।’ বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবিও জানান তিনি। নাট্যগবেষক কামালউদ্দিন কবির, সাইদুর রহমান লিপনও সমাবেশে বক্তব্য দেন।
এর আগে শিল্পকলা একাডেমি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, ৫ আগস্ট–পরবর্তী সময় থেকে জাতীয় নাট্যশালার ৩টি মিলনায়তন, ৬টি মহড়াকক্ষ, সেমিনারকক্ষ, আর্কাইভ কক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুকূলে বরাদ্দ প্রদান করা সম্ভব হয়নি। পরে ১১ অক্টোবর থেকে নাট্যশালার প্রধান মিলনায়তন ও দুটি মহড়াকক্ষ নাটক মঞ্চায়নের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ২ নভেম্বর ছিল নিত্যপুরাণ নাটকের প্রদর্শনী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের সার্বিক নিরাপত্তার স্বার্থে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার বিভিন্ন কক্ষে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরা অবস্থান করছেন।
বিক্ষুব্ধ থিয়েটারকর্মীদের সমাবেশে লিখিত ছয়টি দাবি তুলে ধরে বলা হয়, ‘দেশ নাটকের বন্ধ প্রদর্শনী সাত দিনের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। নাট্যকর্মীরা সবাই পাহারা দেব যেন নির্বিঘ্নে প্রদর্শনী হয়। সাধারণ নাট্যকর্মী, দর্শক, নাগরিকদের জন্য শিল্পকলাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সব কটি হল খুলে দিয়ে নাট্যচর্চার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দিতে হবে। শিল্পকলা পরিষদের আমলানির্ভরতা কমাতে হবে এবং শিল্পকলায় থিয়েটার দলগুলোর প্রদর্শনী বরাদ্দে স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে হবে।’
এদিকে শিল্পকলা একাডেমি সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বাবস্থায় জনগণের, শিল্পচর্চার ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশ্বাস করে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করছে।’ একাডেমির ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের হাজার বছরের নাটকের ইতিহাস আছে। নাটকের মাধ্যমেই সমাজের ত্রুটি–বিচ্যুতি ও বিকল্প ধারণা তুলে ধরা সম্ভব। তাই যারা নাটক করতে চায়, তাদের নাটক করতে দিতে হবে। নাটক দেখেই দর্শক বিবেচনা করবেন তাদের নাটক তাঁরা গ্রহণ করবেন কি না। মতাদর্শ ও শিল্পকলার হাজার মালভূমির এই বাংলাদেশে সব দলের নাটক করার বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সার্বিক সহযোগিতা রয়েছে।’