গ্রামের বৈঠকখানার মতো ঘরটিই ছিল এবারের মঞ্চ
গ্রামের বৈঠকখানার মতো ঘরটিই ছিল এবারের মঞ্চ

আনর্তবাড়ির অশেষ আড্ডা

মঙ্গলবার রাত ৯টা। আনর্তবাড়ির সব আলো নিভে গেল। শুধু মঞ্চে জ্বলে থাকল ২১টি লন্ঠন আর ১০১টি মোমবাতি। আট দিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে যে আনর্ত কর্মীরা মেলা প্রাঙ্গণ সাজিয়েছিলেন, এখন মঞ্চে শুধু তাঁরা। আর দুই বাংলার নাট্যজনেরা নিচে। এ সময় খালি গলায় এক নারী গেয়ে উঠলেন ‘ও আলোর পথযাত্রী এ যে রাত্রী এখানে থেমো না...।’ এই গানের সঙ্গে অতিথিরাই মঞ্চের কর্মীদের অভিবাদন জানালেন। এমন আনন্দঘন মুহূর্তে কারও কারও চোখ ছলছল করে উঠল। এমনই ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের ছোটকাগজ ‘আনর্ত’ আয়োজিত দুই দিনের নাট্যমেলার সমাপনী দৃশ্য।

দুই দিনের মেলায় আনর্ত সম্পাদক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজুকে এই প্রথম মাইক্রোফোন হাতে আনর্তবাড়ির মঞ্চের সামনে দেখা গেল। এই মেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী ভবনের সামনে ঠিক গ্রামের বাড়ির আদলে ঘর তৈরি করা হয়েছিল। গ্রামের বৈঠকখানার মতো ঘরটিই ছিল এবারের মঞ্চ। প্রধান ফটক, বেড়া ও স্টলগুলোও খড় দিয়ে তৈরি। এর নাম দেওয়া হয়েছিল আনর্তবাড়ি।

মেলার দুই দিনের ১৪টি ইভেন্টে রহমান রাজু ছিলেন একেবারে নেপথ্যে। পুরস্কার প্রদানের সময়ও তিনি মঞ্চে ছিলেন না। মেলার শেষ দৃশ্যে মোমের আলোয় তিনি মাইক্রোফোন হাতে এসে দাঁড়ালেন মঞ্চের সামনে। তিনি এসে ব্যাখ্যা দিলেন, ১০১টি মোমবাতি হচ্ছে এই নাট্যকর্মীদের শত বছর পেরিয়ে যাওয়ার প্রতীক আর একুশটি লন্ঠন দিয়ে একুশ শতকে অনুষ্ঠিত এই নাট্যমেলাকে বোঝানো হয়েছে। তিনি আরও বোঝালেন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন হলে অনেক বড় কিছু করা সম্ভব হয়। তার মধ্যে একজন অমানুষ থাকলে সবকিছু পণ্ড হয়ে যায়। এই মিলনমেলা ছিল মানুষের।
এর আগে শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার ছাত্র-শিক্ষক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে মেলার সর্বশেষ নাটক অনুস্বর নাট্যদলের ‘মূল্য-অমূল্য’ মঞ্চস্থ হচ্ছিল। সেটিই ছিল মেলার শেষ আয়োজন।

মঞ্চে ২১টি লন্ঠন আর ১০১টি মোমবাতি

ঠিক সে সময় আনর্তবাড়িতে জমজমাট আড্ডা। দর্শকেরা ভাবছেন এরপর আরও নাটক বা অন্য কিছু রয়েছে। কেউ এসে বলছেন, অনুষ্ঠান আর কয়দিন চলবে। স্টলে তখনো নাটকের ছোটকাগজ নিয়ে নাট্যকর্মীরা বসে আছেন। রাত ৯টা বাজার কিছুক্ষণ আগে দুজন নাট্যকর্মী মঞ্চে ঝোলানো লন্ঠনগুলো জ্বালিয়ে দিলেন। আর মঞ্চের চারপাশ দিয়ে মোমবাতিগুলো সাজিয়ে দিচ্ছিলেন।

এরপরই অতিথিরা এসে মঞ্চের সামনে বসলেন। তখন রহমান রাজু শোনালেন গোবর দিয়ে আনর্তবাড়ির উঠান প্রস্তুতের গল্প। নাট্যকলা বিভাগের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কাজ করেছেন। আরও শোনালেন আনর্তবাড়িটি গ্রামীণ ঢঙে না করে শহুরে আদলে করলে হয়তো কম খরচেই হতো কিন্তু এমন প্রাণের ছোঁয়া থাকত না। এই কাজ হয়েছে গ্রাফিক ডিজাইনার মো. সোহেল রানা ও শিল্পনির্দেশক অর্ঘ্য অধিকারীর নির্দেশনায়। এই পর্বে তাঁদের দুজনের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিলেন নাট্যজন মলয় ভৌমিক।

অতিথিদের সঙ্গে আনর্তনাট্যকর্মীরা

এবার সব নাট্যকর্মী উঠে গেলেন মঞ্চে। নিচে থাকলেন অতিথিরা। বিদ্যুতের সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। আনর্তবাড়ি তখন শুধু লন্ঠন আর মোমের মিষ্টি আলোয় অপরূপ লাগছে। এ সময় সেই গান ‘ও আলোর পথযাত্রী ...এখানে থেমো না।’ এ সময় কলকাতার নাট্যজন মলয় মিত্র মাইক্রোফোন হাতে বললেন, এই সুন্দর আয়োজনের জন্য আয়োজক রহমান রাজুকে স্যালুট জানানো যেতে পারে। রহমান রাজু বললেন, স্যালুট জানাতে হবে মঞ্চের ওই নাট্যকর্মীদের। তিনি মঞ্চের দিকে ফিরে নাট্যকর্মীদের স্যালুট জানালেন। তাঁর সঙ্গে সব অতিথি।

গান শেষ হওয়া পর্যন্ত সবাই স্যালুট জানানোর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেন। এভাবেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) রাতে শেষ হলো দ্বিতীয় আনর্ত নাট্যমেলা ২০২৪। মেলা ভাঙল কিন্তু আড্ডা শেষ হয় না। আবার কবে দেখা হবে এই নিয়ে আরও আড্ডা চলতে থাকল।

মেলার শেষ দৃশ্যে আনর্ত সম্পাদক রহমান রাজু

এদিকে আনর্তবাড়ির সঙ্গেই করা হয়েছিল রান্নাঘর। ডাক পড়ল রান্নাঘর থেকে। বাবুল বিশ্বাস এবার আনর্ত পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। রান্নাঘরে গিয়ে তিনি ফের আড্ডায় মেতে উঠেছেন। ওর মধ্যেই চলছে ছবি তোলা। খেতে বসেছেন এপার বাংলার এক নাট্যজন। ওপার বাংলার মলয় মিত্র খাবেন না। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘নারে আর খাবনা রে। এত বেশি খাওয়াচ্ছে। যেন খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ফেলবে।’ যিনি খাচ্ছিলেন তিনি এবার হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমরা বুঝি খাওয়াও না। তোমরাও খাওয়াও। এই ভেবে খাওয়াও যে বাঙালরা খেতে এসেছে।’ এরপর হাসি আর হাসি।