ছিল নতুন নাটক, উৎসবের আয়োজন হয়েছে। তবে শুরুটা ভালো হলেও বছরটা ভালো যায়নি। বছরের মাঝামাঝি সময়ে ছিল বড় ধাক্কা। বছর শেষে নাটক পাড়ায় ফিরে দেখেছেন মাসুম অপু।
‘২০২৪: হতে পারে নতুন মঞ্চনাটকের বছর’ চলতি বছরের প্রথম দিনের প্রথম আলোর ‘বিনোদন’ পাতার শিরোনাম ছিল এমনই। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। চব্বিশে ভালো যায়নি মঞ্চনাটক। সংখ্যায় কম নাটক যেমন হতাশ করেছে, তেমনি প্রদর্শনীর মাঝখানে নাটক বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন টানা বন্ধ ছিল মিলনায়তন।
একনজরেমোট নতুন নাটক: ২৪(গ্রুপ থিয়েটার প্রযোজনা ১৪, রেপার্টরি প্রযোজনা ১০)মোট পথনাটক: ২৯উৎসব: ১৩নতুন দল: ৩আলোচিত উদ্যোগ: ‘লাল মজলুম’
তবে হতাশার মধ্যেও কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে নতুন নাটক, নাটক নিয়ে ব্যতিক্রম উদ্যোগ এবং তরুণদের নতুন দল। মঞ্চে এ বছর তুলনামূলক রেপার্টরি দলের কার্যক্রম বেশি ছিল।
নতুন নাটক মোটে ২৪
বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভসের সূত্র অনুযায়ী সব মিলিয়ে এ বছর মঞ্চে এসেছে ২৪টি নতুন নাটক। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩। তার আগের বছর অর্থাৎ করোনার পরের বছর ছিল ৩৪টি নতুন নাটক। গেল দুই বছরের তুলনায় এবার অনেক কম নাটক এসেছে।
নিয়মিত নাটক দেখেন, নাটকের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত, এমন ১০ জনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম চলতি বছর তাঁদের নতুন নাটক দেখার অভিজ্ঞতা। কেউ পাঁচটি নাটকের নাম দিয়েছেন; কেউ আবার মাত্র একটি নাটকের নাম দিয়ে বলেছেন, ‘আমার এই একটি নাটকই ভালো লেগেছে।’ সবার মতামত ও তথ্য মিলিয়ে মনে হলো, এ বছর মনে দাগ কাটার মতো নাটক তুলনামূলক কম।
ঘুরেফিরে এসেছে ‘প্যারাবোলা (বাতিঘর), ‘পারো’ (দেশ নাটক), ‘কম্পানি’ (আরণ্যক), ‘মহাশূন্যে সাইকেল’ (অনুস্বর), ‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’ (অনুস্বর), ‘টিনের তলোয়ার’ (প্রাঙ্গণেমোর), ‘উনপুরুষ’ (নবরস নৃত্য ও নাট্যদল), ‘দ্য ম্যান আউটসাইড’ (অ্যাক্টোমেনিয়া), ‘প্রায় তিন/চারজন’ (প্রচণ্ড কালেকটিভ), ‘মেয়েটি’ (নাট্যহীত, চট্টগ্রাম), ‘খোঁজ’ (ফেইম), ‘বোধ’ (স্বপ্নঘুড়ি রেপার্টরি) ইত্যাদি নাটকের নাম। এর মধ্যে কিছু নাটকের শো হয়েছে একেবারেই কম। সার্বিক বিবেচনায় নাট্যগবেষক বাবুল বিশ্বাস মনে করেন, এসব নাটক তুলনামূলক আলোচনায় থাকলেও সংশ্লিষ্ট দলগুলো আগের কাজকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তাঁর ভাষ্যে, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আলোচনায় আসার মতো নতুন নাটক নগণ্য। অবশ্য দলগুলো সময়ও কম পেয়েছে।
আলোচিত ১০ নাটক‘প্যারাবোলা’ (বাতিঘর)‘পারো’ (দেশ নাটক)‘কম্পানি’ (আরণ্যক),‘বিবিধ শোক অথবা সুখ’ (অনুস্বর)‘টিনের তলোয়ার’ (প্রাঙ্গণেমোর)‘উনপুরুষ’ (নবরস নৃত্য ও নাট্যদল)‘দ্য ম্যান আউটসাইড’ (অ্যাক্টোমেনিয়া)‘প্রায় তিন/চারজন’ (প্রচণ্ড কালেকটিভ)‘মেয়েটি ’(নাট্যহীত, চট্টগ্রাম),‘খোঁজ’ (ফেইম, চট্টগ্রাম)
নাটকহীন ৮৪ দিন
জুন পর্যন্ত নিয়মিতই নাটকের মঞ্চায়ন হচ্ছিল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে পরে ধীরে ধীরে কমতে থাকে প্রদর্শনী। গত ১৯ জুলাই শিল্পকলা পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে ম্যাড থেটারের আনা ফ্রাঙ্ক-এর প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাটকটি আর মঞ্চস্থ হয়নি। আর কারফিউ জারির পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তন ও মহড়াকক্ষ। এভাবে কেটে যায় ৮৪ দিন! ১১ অক্টোবর সন্ধ্যায় আবার জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে আলো পড়ে। করোনাকাল বাদ দিলে এত দীর্ঘ সময় নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ থাকেনি বলে জানিয়েছেন এই অঙ্গনের জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা।
মঞ্চে আলো পড়ল। মহড়াকক্ষও খুলল। চলছিল বেশ। ২ নভেম্বর ঘটল আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দেশ নাটক প্রযোজিত ‘নিত্যপুরাণ’ নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেদিন। একদল লোক শিল্পকলার গেটের সামনে দেশ নাটকের এক সদস্যকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলে শিল্পকলার মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদ দেশ নাটকের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে প্রদর্শনী বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দেন। পরদিন এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসে নাটক বন্ধের কারণ, ওই সময়ের পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে কথা বলেন মহাপরিচালক। জানান, দর্শকের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে নাটকের প্রদর্শনী মাঝপথে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরিস্থিতি দেখে তাঁর আশঙ্কা হয়েছিল যে শিল্পকলা একাডেমিও আক্রান্ত হতে পারে।
পরে এ ঘটনার প্রতিবাদে শিল্পকলা একাডেমির প্রবেশদ্বারের মুখে সমাবেশ করেন শতাধিক নাট্যকর্মী। সমাবেশ চলাকালীন কয়েকজন লোক পেছন থেকে ডিম ছুড়ে মারেন। পরে বক্তব্যে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘সভা শেষ করব না। ভেতরে নাটক হবে, বাইরে আমরা পাহারা দেব।’
নভেম্বর মাসে একই মঞ্চে পরে নির্বিঘ্নে মঞ্চস্থ হয় ‘নিত্যপুরাণ’। বর্তমানে স্বাভাবিকভাবে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। একাডেমি চত্বরের বাইরেও কর্মসূচি ছড়িয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে নভেম্বর মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মুক্তমঞ্চে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে আয়োজন করা হয় সাত দিনব্যাপী যাত্রা উৎসবের। শুরুর দিন থেকেই সেখানে পালা দেখেন নানা শ্রেণির হাজার হাজার দর্শক। নভেম্বর মাসে নাটকের শিক্ষক শাহমান মৈশানের নির্দেশনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয়ে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গিয়ে শেষ হওয়া গণপরিবেশনা ‘লাল মজলুম’ বেশ সাড়া ফেলে। এতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতিসহ গণমানুষের ওপর নির্যাতন, সংগ্রাম ও গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি উপস্থাপন করেছেন নির্দেশক।
নতুন সংগঠন, নতুন ফেডারেশন
১৯৮০ সালের নভেম্বর মাসে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। বলা যায়, তারপর চার দশকের বেশি সময় দেশের নাট্যাঙ্গনে এই একটি সংগঠনেরই একক প্রভাব ছিল। ২০১৮ সালে হয়েছিল সর্বশেষ কমিটি। ছয় বছর পর গত অক্টোবরে ফেডারেশনে লিয়াকত আলী লাকী যুগের অবসান হয়। নির্বাচিত নতুন কোনো কমিটি এখন ফেডারেশনে নেই। এর মধ্যে ১৯ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেছে থিয়েটার আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ঢাকা।
উদ্যোক্তাদের দাবি, ঢাকার মঞ্চনাটকের শিল্পীদের অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে নতুন এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ। আজাদ আবুল কালামকে সভাপতি এবং সাইফ সুমনকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত এ সংগঠন ঢাকা মহানগরে মঞ্চে বা মঞ্চের নেপথ্যে যুক্ত নাট্যশিল্পীদের নিয়ে সামগ্রিক কল্যাণে কাজ করতে চায়।
শিল্পকলা একাডেমির নেতৃত্বে এসেছেন অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ, যিনি মূলত নাটকেরই মানুষ। দায়িত্ব নিয়ে নাটক তথা সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ও বিকাশে বেশ কিছু ইতিবাচক কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তিনি। নাট্যাঙ্গনে তরুণেরা এসেছেন নতুন উদ্যমে। এসেছে নতুন নেতৃত্ব। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আশা, সামনের বছর এই অঙ্গনে সুদিন ফিরবে।