গেল কয়েক বছর রাজধানী ঢাকার নাটকের উৎসবগুলো শুধু ছিল শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক। কখনো কখনো তা বেইলি রোডের মহিলা সমিতি পর্যন্ত যেত। এখন শহরে উৎসবের নতুন নতুন জায়গা হয়েছে। উৎসব ছড়িয়ে পড়ছে শহরের নানা প্রান্তে।
গত সোমবার শিল্পকলা একাডেমিতে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের তিন যুগ পূর্তি উপলক্ষে ১০ দিনব্যাপী ‘বাংলা নাট্য উৎসব’ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন, বাংলাদেশ মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনের পাশাপাশি রাজধানীর উপকণ্ঠে দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে পৌঁছে গেছে এই উৎসব। চলবে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের পাঁচটি নাটকসহ বাংলা ভাষাভাষীর ৩১টি নাটক রয়েছে এই আয়োজনে। আয়োজক ছাড়াও বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারী দলগুলো হচ্ছে দেশনাটক, প্রাচ্যনাট, থিয়েটার আর্ট ইউনিট, নাট্যচক্র, বুনন থিয়েটার, শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র, আরণ্যক নাট্যদল, থিয়েটার সার্কেল, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা থিয়েটার, ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী, নাট্যতীর্থ, নাট্যম রেপার্টরি, লোক নাট্যদল (বনানী), সময়, নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বল, বটতলা, অনুরাগ থিয়েটার, চন্দ্রকলা থিয়েটার, নবনাট, পদাতিক নাট্য সংসদ (টিএসসি), বাংলাদেশের পুতুলনাট্য গবেষণা কেন্দ্র, কথক, নাট্যযোদ্ধা, বাঙলা নাট্যদল, মেঠোপথ।
গেল বুধবার থেকে দনিয়া এলাকা স্টুডিও থিয়েটারে শুরু হয়েছে উৎসবের নাটক প্রদর্শনী। দারুণ সাড়া মিলেছে বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ সদস্য শাহনেওয়াজ। দনিয়া এলাকার কিছু সংস্কৃতিমনা তরুণের উদ্যোগে এই স্টুডিও থিয়েটার। আশির দশকের একেবারে শেষ ভাগে কয়েকজন তরুণের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে দনিয়া পাঠাগার। গোয়ালবাড়ি মোড়ের সেদিনের সেই টিনের ঘরের পাঠাগার থেকেই গড়ে উঠেছে আধুনিক মানের স্টুডিও থিয়েটার হল। দনিয়া পাঠাগারের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে এটি। এখানে একসঙ্গে ১০০ জন দর্শক প্রদর্শিত নাটক কিংবা চলচ্চিত্র দেখতে পারছেন। এই মঞ্চে এরই মধ্যে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। চলমান বাংলা নাট্য উৎসবে দর্শকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
জানা গেছে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি এটি উদ্বোধন করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। উদ্বোধনী দিন থেকে চার দিনব্যাপী চলে আন্তর্জাতিক একক নাট্যোৎসব (ভারতের তিনটি ও বাংলাদেশের চারটি দল এতে অংশ নেয়)। এরপর ২২ থেকে ২৬ মার্চ চলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র উৎসব। এ বছর ২৩ মার্চ দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র উৎসবে স্কুল ছাত্রছাত্রীরা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’ উপভোগ করে। এ ছাড়া শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দীপু নাম্বার টু’ এবং মঞ্চনাটক ‘অতঃপর মাধো’র প্রদর্শনীও উপভোগ করে শিক্ষার্থীরা।
২১ জুন দনিয়া সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে এবং দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার হলের সহযোগিতায় ‘আধুনিক বাংলা নাট্যে নিজস্বতার খোঁজ’ শীর্ষক সেমিনারে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশি-বিদেশি সংস্কৃতিকর্মী উপস্থিত হয়েছিলেন। এতে ভাবনা থিয়েটার ম্যাগাজিন, কলকাতার সম্পাদক অভীক ভট্টাচার্যের প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আফসার আহমেদ, নাট্যজন অনন্ত হীরা এবং নাট্য সমালোচক আবু সাঈদ তুলু। অনুষ্ঠানে ভারতের বিশিষ্ট নাট্যগবেষক আশীষ গোস্বামীও আলোচনায় অংশ নেন।
সবুজবাগে ত্রিনয়নী নাট্যোৎসব
সোমবার শহরের মূল কেন্দ্রের বাইরে আরেকটি উৎসব শুরু হচ্ছে। কালীপূজা উপলক্ষে রাজধানীর সবুজবাগে অবস্থিত শ্রীশ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির প্রাঙ্গণে সোমবার থেকে শুরু হচ্ছে ত্রিনয়নী নাট্যোৎসব। ‘মঞ্চের উচ্চারণ শুভবোধের উন্মোচন’ স্লোগানে দুই দিনের এই উৎসবে মঞ্চস্থ হবে চারটি নাটক।
নাট্যোৎসবের আহ্বায়ক এবং বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের সভাপতি চিত্ত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে জানান, উদ্বোধনী দিনে আজ রাত আটটায় মঞ্চস্থ হবে লোক নাট্যদলের ময়মনসিংহ গীতিকা-আশ্রিত নাটক ‘সোনাই মাধব’। রাত ১০টায় পদাতিক নাট্য সংসদ প্রযোজিত নাটক ‘বেদের মেয়ে’। আগামী মঙ্গলবার রাত আটটায় ঢাকা পদাতিকের নাটক ‘পাইচো চোরের কিসসা’। রাত ১০টায় সংস্কার নাট্যদলের নাটক ‘গীতি চন্দ্রাবতী’। উৎসবের আহ্বায়ক চিত্ত রঞ্জন দাস বলেন, ‘শারদীয় নাট্যোৎসবে বিপুল দর্শক সমাগমের কারণে আমরা অনুপ্রাণিত হয়েই কালীপূজায় দুই দিনব্যাপী নাট্যোৎসব করছি। বিনোদন ও শিক্ষার যৌথ অবস্থানে নাট্যে পরিবেশন আমাদের উৎসবকে পরিপূর্ণতা দেবে বলেই বিশ্বাস।’
এর আগে বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির প্রাঙ্গণে সফলভাবে আয়োজন করা হয়েছিল ‘শারদীয় নাট্যোৎসব’। ‘মঞ্চমায়ায় মানবতার জয়’ স্লোগান নিয়ে ৪ অক্টোবর থেকে পাঁচ দিন শারদীয় নাট্যোৎসব হয়েছিল সম্রাট আকবরের প্রধান সেনাপতি মানসিংহের স্মৃতিবিজড়িত রাজারবাগের গঙ্গাসাগর দিঘির পাড়ে বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির প্রাঙ্গণে। আয়োজক বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দির ও শ্মশান পরিচালনা কমিটি। উৎসবে থিয়েটারের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, মণিপুরি থিয়েটারের ‘কহে বীরাঙ্গনা’, দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’, থিয়েটার ৫২র নতুন নাটক ‘কালীদাস’, আরণ্যক নাট্যদলের ‘ময়ূর সিংহাসন’, স্বপ্নদলের ‘জাদুর প্রদীপ’, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘বাংলা আমার বাংলা ও সেই সব দিনগুলো’, চন্দ্রকলা থিয়েটারের ‘তন্ত্রমন্ত্র’, বহুবচন নাট্যদলের ‘অনিকেত সন্ধ্যা’, ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ হয়।
বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের সভাপতি শারদীয় নাট্যোৎসবের আহ্বায়ক চিত্তরঞ্জন দাস প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯৫ সাল থেকে নাট্যোৎসবের আয়োজন করছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘একসময় “ভক্ত গিরিশ”, “ভক্ত প্রহ্লাদ”, “মহারাজা হরিশ্চন্দ্র”, “রাম-সীতা” প্রভৃতি পৌরাণিক এবং ঐতিহাসিক নাটক করতাম। এটা এক অর্থে আমাদের মতো করে আমাদের নির্মাণ, আমাদের আঞ্চলিক আবহের মধ্য দিয়ে উদ্যাপন শুরু ও শেষ ছিল। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে আমরা আমাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ নাট্যোৎসব ও সাংস্কৃতিক আয়োজন নিয়ে দর্শকদের বিনোদন দেওয়ার চেষ্টা করছি। গত কয়েক বছর দেখেছি, এখানে মেলা-দিঘি-দেবী দেখতে যেমন অনুরাগীর ঢল নামে, ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয় দেখতে অনুরাগী দর্শক-শ্রোতার মিলনমেলা তৈরি হয়। আমরা এখানে নিয়মিত নাট্য উৎসব চালিয়ে যাব।’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘এটা খুবই ভালো লক্ষণ যে আমাদের সাংস্কৃতির চর্চা, পরিবেশনা এখন শুধু শহরের মধ্যখানে নয় বরং ছড়িয়ে পড়ছে নানা প্রান্তে। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিও ছিল। কেননা, যত নতুন নতুন সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হবে, তত এর কদর বাড়বে, চর্চা বাড়বে। অন্যদিকে বাস্তবতা হলো, যানজটের এই নগরীতে এখন সময় করে দূরে আসাও কষ্টসাধ্য বটে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায়িত্ব মানুষের কাছে বেশি পরিমাণে পৌঁছে যাওয়া।’