সুনসান মহড়াকক্ষগুলো। কোনো শব্দ নেই। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে সাততলায় পৌঁছাই। হ্যাঁ, এবার শব্দ শোনা যায়। উঁকি দিয়ে বোঝা গেল, ভেতরে মহড়া চলছে। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখে পড়ে অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমকে। তিনি আজ নির্দেশকের ভূমিকায়। গলায় ঝোলানো বাঁশি। ওটা কি মাঝেমধ্যে বেজে ওঠে? জিজ্ঞাসা করা হয়নি। পাশেই বসা রোজী সিদ্দিকী।
সেলিম ভাই বললেন, ‘ও তুমি, প্রথম আলো থেকে?’
মাথা ঝুলিয়ে বলি, ‘হ্যাঁ।’
বললেন, ‘বসো।’
আর কোনো কথা নেই। পুরো মনোযোগ নির্দেশনায়। শিল্পকলা একাডেমির চিলেকোঠার ১ নম্বর মহড়াকক্ষ হয়ে উঠেছে যেন কোনো টার্মিনাল। কালো কার্পেটের ওপর রাখা লোহার থাম। কোনো থামে জড়ানো মোটা রশি। টার্মিনালে অপেক্ষায় কিছু মানুষ।
নাম না জানা এক ভাইরাস এসে হানা দিয়েছে শহরে। মানুষের দেহে ছিদ্র হয়ে সেখান থেকে বের হচ্ছে কষ। পচে যাচ্ছে শরীর। অসহায় মানুষ। পালাচ্ছে শহর ছেড়ে। তারা উপস্থিত হয় এই স্টিমারঘাটে। অপেক্ষায় একটি স্টিমারের। কিন্তু স্টিমার কি আসবে? তারা জানে না, কিন্তু খুঁজে ফেরে এই ভাইরাসের কারণ। দায়ী করে নিজেদের। তাদের মুখ থেকেই বের হয় শহরের সব অপরাধের কথা। রাজনৈতিক দূষণ, পোশাকশিল্পে জীবিকার বৈষম্য, প্রশাসনে দুর্নীতি, সরকারি চাকরিপ্রাপ্তিতে লেনদেন, হাসপাতাল-ক্লিনিকের নীতিহীন বাণিজ্য—এগুলো করেছে তারা। শুধু তা–ই নয়, মানুষের নিত্যপণ্যের বাজার—মাছ, মরিচ, বেগুন, পটোলে ঢেলে দিয়েছে ফরমালিন। এমনকি সবুজ পেঁপে, আম, কলা পাকানোর যে স্বাভাবিক রীতি, তা–ও তারা বদলে ফেলেছে। কার্বাইড দিয়ে পাকানোর অপরাধবোধটুকুও ভুলে গেছে তারা। এই অপরাধ কি সইবে প্রকৃতি?
মহড়া চলে। পাণ্ডুলিপি হাতে পেছন থেকে বেরিয়ে এলেন ঝাঁকড়া চুলে রাহুল আনন্দ। থামিয়ে দেন মহড়া। নির্দেশকের অনুমতি নিয়ে অভিনেতাকে বুঝিয়ে দেন কোথায় সংগীত থামবে, কোথা থেকে শুরু হবে সংলাপ। অভিনেতা সংলাপ বলেন, কিন্তু তাল মিলছে না বাদ্যের। রাহুল নিজে গিয়ে বুঝিয়ে দেন, ‘এভাবে করো, ধা ধা ধা।’ আবার শুরু হয় মহড়া।
সময়টা ২০০০ সাল। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে অসংখ্য মানুষ অপেক্ষায় ফেরি পারাপারের জন্য। নাট্যকারের মাথায় এই গল্পের পোকাটি ঢুকে পড়ে তখন। নাট্যকার আনন জামান এমনটাই বলছিলেন। মাথার ভেতর ভনভন করে ঘুরতে থাকা গল্পটি খসখস করে লেখা হয়ে যায় কাগজে। উঠে আসে দেশের ভয়াল সব দৃশ্য। কিন্তু কিছুদূর লিখে থেমে যান নাট্যকার। আনন জামান বলেন, ‘ভাইরাসে আক্রান্ত শহর–পালানো মানুষেরা ঘাটে এসে স্টিমারের জন্য অপেক্ষা করছে। এ পর্যন্ত লিখে থেমেছিলাম। লেখার জন্য নিজেকে পরিণত মনে হচ্ছিল না। ২০১৭ সালে আমার দুই প্রিয়মুখ শহীদুজ্জামান সেলিম ও রোজী সিদ্দিকী এলেন নতুন নাটকের গল্প শুনতে। তখন শোনালাম। জামান ভাইয়ের উচ্ছ্বসিত প্রেরণায় পুনরায় লেখা শুরু করি।’
কথা হয় নির্দেশকের সঙ্গে। শহীদুজ্জামান সেলিম জানালেন, এই সময়ে ভীষণ সমসাময়িক এই নাটক। তাই করোনাকালেই শুরু করেছিলেন মহড়া। তিনি বলেন, ‘এমনভাবে অনলাইনে মহড়া করতে হবে ভাবিনি কোনো দিন। এটা নতুন এক ভাবনা।’
জিজ্ঞাসা করি, ‘নতুন স্বাভাবিকে দর্শক কি আসবে তেমন?’
সেলিম বলেন, ‘হলভর্তি দর্শক হবে, এ আশা করি না। তবে এই সময়ে সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তাঁদের মধ্যে কেউ যদি এই নাটক দেখে মানসিকভাবে স্বস্তি পান, এটাই বড় পাওয়া। প্রকৃতির সঙ্গে আমরা যে অন্যায় করছি, এটা যেন ভবিষ্যতে না হয়, সেই ধারণা পাওয়া যাবে এই নাটকে।’
মঞ্চ পরিকল্পনা নিয়ে নাটকটির সঙ্গে যুক্ত আফজাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘দলে নতুন প্রযোজনা হলে কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে থাকি। এই সময়ে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে মঞ্চে একটি নাটক নিয়ে আসছে, এটা অনেক বড় একটা বিষয়। এটা এমন একটি কাজ, যেটি করা হচ্ছে অনেকে মিলে এবং অনেকে সেটা আবার দেখতে আসবে। একটা লম্বা সময় ধরে আমাদের স্বাভাবিক জীবন তো নাই। এটা নানাভাবে একটা সংকট তৈরি করে। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি, এই প্রযোজনাটা একটা বড় ভূমিকা রাখবে।’
প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অন্যায়ের ফল এই মহামারি। বিপর্যস্ত এই সময়ে এক টুকরা স্বস্তি হতে পারে মঞ্চনাটক। নতুন স্বাভাবিকে আজ শুক্রবার ‘একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার’ নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেন ঢাকা থিয়েটারের অভিনেতারা; জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে, সন্ধ্যা সাতটায়। আগামীকাল শনিবারও থাকছে আরেকটি প্রদর্শনী।