করোনার প্রকোপ কমছে। মঞ্চেও জ্বলছে আলো। বছরের শুরু থেকে নাট্যপাড়া আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করে। নতুন নাটক, উৎসব আর পরিবেশ থিয়েটার মিলিয়ে বছর শেষে কিছুটা প্রাণের সঞ্চার হয় নাটকপাড়ায়।
নতুন নাটক
করোনাকাল কাটিয়ে নতুন করে দর্শকের মঞ্চে ফেরা নিয়ে ছিল অনিশ্চয়তা। তা যে খুব কেটেছে, এমনটি নয়। তবে দর্শকের জন্য তৈরি ছিলেন নাট্যকর্মীরা। বেশ কিছু নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। নাটকের দল বটতলা ও যাত্রিক যৌথভাবে মঞ্চে নিয়ে আসে নাটক ‘সোহোতে মার্ক্স’। হাওয়ার্ড জিনের নাটকটি অনুবাদ করেছেন জাভেদ হুসেন। নির্দেশনা দিয়েছেন নায়লা আজাদ। হুমায়ুন আজম ও উম্মে হাবিবা অভিনয় করেছেন। নাটকটিতে মার্ক্সের চোখ দিয়ে বর্তমান পৃথিবীকে দেখিয়েছেন জিন। বিষয়গুণ ও অভিনয়—দুই দিক দিয়ে আলোচিত ছিল এই নাটক।
ম্যাড থেটারকে একটি পারিবারিক থিয়েটার বললে ভুল হয় না। নাট্যকর্মী আসাদুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী সোনিয়া হাসান ও কন্যা আর্য মেঘদূতকে নিয়ে এই দল গঠিত। এবার কন্যাকে নিয়ে মঞ্চে এসেছেন আসাদা–সোনিয়া দম্পতি। নাটকের নাম ‘আনা ফ্রাঙ্ক’। আনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন মেঘদূত। লিখেছেন আসাদুল ইসলাম ও নির্দেশনা দিয়েছেন কাজী আনিসুল হক।
সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে আপস্টেজ মঞ্চে এনেছে ‘স্বপ্নভুক’। এটি নির্দেশনা দিয়েছেন সাইফ সুমন। অভিনয়ে মোহাম্মদ বারী ও এস আর সম্পদ। বছর শেষের আরেক আলোচিত নাটক ছিল মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় ‘জনকের অনন্তযাত্রা’। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় নাটকটির মাধ্যমে অনেক দিন পর মঞ্চে ফিরেছেন আজিজুল হাকিম, মুনিরা ইউসুফ মেমী ও কামাল বায়েজীদ।
এখানেই শেষ নয়, মঞ্চে এসেছে নাট্যম রেপার্টরির ‘কোথায় জলে মরাল চলে’। মোহন রাকেশ রচিত ‘লেহরো কা রাজহংস’ অবলম্বনে নাটকটি অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। নির্দেশনা দিয়েছেন আইরিন পারভীন। এ ছাড়া রাজধানীতে এবং এর বাইরে আরও কিছু নতুন নাটক তৈরি হয়েছে, বিভিন্ন নাটকের দলের স্কুল ও কর্মশালা প্রযোজনা মঞ্চায়িত হয়েছে।
নাটক গেল বসার ঘরে
সৈয়দ জামিল আহমেদ বছর শেষে হাজির হলেন এক অভিনব প্রযোজনা নিয়ে। রাজধানীতে জ্যাম ঠেলে মিলনায়তনে গিয়ে নাটক দেখা কঠিন বটে! তাই নাটক নিয়ে তিনি হাজির হলেন দর্শকের একেবারে বসার ঘরে। স্পর্ধা: ইনডিপেনডেন্ট থিয়েটার কালেক্টিভের ব্যানারে তিনি ব্রিটিশ নাট্যকার ডানকান ম্যাকমিলানের ‘এভরি ব্রিলিয়ান্ট থিং’ নাটকটি নিয়ে এলেন ‘বিস্ময়কর সবকিছু’ নামে। জ্যামে জড়াগ্রস্ত এই রাজধানীতে দর্শকের দোরগোড়ায় হাজির হতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বাড়িতে বাড়িতে চলে নাটকটির প্রদর্শনী। মহসিনা আক্তারের একক অভিনয়ে নাটকটি গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে মঞ্চায়িত হয়েছে। এই অভিনব আয়োজন দর্শকের শুধু ভালোই লাগেনি, গ্রহণ করেছে সাদরে।
‘মুক্তি’র ১০০
থিয়েটারের নাটক ‘মুক্তি’। ১৭ বছর আগে মঞ্চে এসেছিল এটি। নাটকটিতে অভিনয় করেছেন ফেরদৌসী মজুমদার, তানভীন সুইটি, তানজুম আরা পল্লী ও তামান্না ইসলাম। নাটকটির শততম রজনী পূর্ণ হয়েছে এ বছর। অনেক নাটকেরই শততম মঞ্চায়ন হয়েছে। কিন্তু মুক্তি একটু ব্যতিক্রম। নাটকের প্রতিটি রজনীতেই এই চারজন শিল্পী অভিনয় করেছেন। শুধু তা–ই নয়, নাটকটিতে চারজন নারী অভিনয় করেছেন। নাটকটির নির্দেশকও একজন নারী, ত্রপা মজুমদার। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের থিয়েটারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলা চলে।
হয়েছে উৎসবও
রাজধানীতে নাটকের বড় আয়োজন গঙ্গা–যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসবে এবার ১৪০টি সাংস্কৃতিক দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩৬টি নাট্যদল ৩৬টি মঞ্চনাটক প্রদর্শন করে। পথনাটক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীতসহ নানা আয়োজনে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার শিল্পী–কলাকুশলী অংশগ্রহণ করেন। মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা নাট্যোৎসব। ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা উদ্বোধন করেন এই বর্ণিল আয়োজন। সেখানে ছিল ৫০ বছরের নাটকের পোস্টার ও স্থিরচিত্র প্রদর্শনী ও সম্মাননা।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিমের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন উপলক্ষে নাট্যোৎসবের আয়োজন করে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি। এ ছাড়া বরাবরের মতোই সৈয়দ মহিদুল ইসলাম স্মরণ উৎসব আয়োজন করে ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী। পদাতিক নাট্য সংসদ আয়োজন করে সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব ও স্মারক সম্মাননা। দেওয়া হয় লোক নাট্যদল স্বর্ণপদক, আলী যাকের সম্মাননা। মণিপুরি থিয়েটারের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজন করে বছরব্যাপী আয়োজন।
গণহত্যা পরিবেশ থিয়েটার
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করে গণহত্যা পরিবেশ থিয়েটার। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পরিকল্পনায় এই কর্মযজ্ঞ চলছে দেশব্যাপী ৬৪টি জেলার ৬৫টি বধ্যভূমিতে। আয়োজন প্রসঙ্গে লিয়াকত আলী লাকীর ভাষ্য, ‘যেখানে ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, ঠিক সেখানেই নাটক মঞ্চস্থ করে পরিবেশ থিয়েটার প্রকৃত অর্থে পরিবেশবাদী হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে এ কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশাবাদী।’