মামুনুর রশীদনাসিরুদ্দিন শাহ কিছুদিন আগে একটা মন্তব্য করে খুবই সমালোচিত হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, অভিনেতা তৈরি করা যায় না, অভিনেতা জন্মায়। ভারতের নাট্য পরিচালক, অভিনেত্রী, সংগঠক, নাট্যকার ঊষা গাঙ্গুলি সম্ভবত সেই পর্যায়েই পড়েন। তিনি এসব কাজের জন্যই যেন জন্মেছিলেন। যাঁর ছিল একটা নিজস্ব রাজনীতি। তিনি থাকতেন কলকাতায় কিন্তু কাজ করতেন ভারতীয় পরিমণ্ডলে। সুবিধা ছিল হিন্দি তাঁর মাতৃভাষা এবং ভারতের সর্বত্রই তিনি নাটক নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন কোর্ট মার্শাল, রুদালী, হিম্মতীমাই নাটক নিয়ে। তাঁর নাট্য প্রযোজনার একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, যা তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ।
২০১৫ সালে ঊষা গাঙ্গুলি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের একটি প্রযোজনা নির্দেশনা দিয়েও সাড়া জাগিয়েছেন। নাটকটি হলো সাদত হাসান মান্টোর তিনটি গল্প নিয়ে তাঁরই নাট্যরূপে নাম–গোত্রহীন। ভারত বিভাগের সময় সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অসহায় নারীকুলের ভাগ্য বিড়ম্বনার গল্প। কলকাতা থেকে বারবার এসে প্রচুর পরিশ্রম করে নাটকটি দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশে আসা-যাওয়া এবং সবশেষে একটি নাটক নির্দেশনা ছিল তাঁর বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় সেই আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করেছিল।ঊষা গাঙ্গুলির আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও অবদান অসামান্য। ১৯৭১ সালে তাঁর গৃহটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় আশ্রয়স্থল। স্বামী ছিল কমিউনিস্ট নেতা এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বড় একজন সমর্থক। সে সময় ঊষা ছিলেন সন্তানসম্ভবা। সেই শরীর নিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাইয়েছেন। আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
হিন্দি নাটকের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের নাটক, নৃত্যনাট্য এবং ছোট ছোট নাটকের প্রযোজনাও করেছেন। তিনি রাজনৈতিক নাটকে বিশ্বাস করতেন। আজীবন বাম চিন্তাধারার মানুষ ঊষা গাঙ্গুলি ছিলেন আপসহীন। বাম দলগুলোর সঙ্গেও তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার মতানৈক্য হতো। তাঁর রচিত নাটক রুদালী মঞ্চে দারুণভাবে প্রশংসিত হয়। পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রেও দারুণভাবে দর্শককে আলোড়িত করে। হিন্দিতে কোর্ট মার্শাল অভিনীত হওয়ার পর বাংলাদেশে এস এম সোলায়মান বাংলায় অনুবাদ করে মঞ্চে নাটকটি নিয়ে আসেন এবং নাটকটি দর্শকনন্দিত হয়। ঊষা গাঙ্গুলির আবাস কলকাতা হলেও সারা ভারতই ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র, বাংলাদেশ ছিল তাঁর মাতৃভূমির মতোই প্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের একজন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বাংলাদেশের নাটকের একজন গুণমুগ্ধ দর্শক হিসেবে এ দেশের নাট্যকর্মীদের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণভাবে প্রিয়। তাঁর প্রয়াণে আমরা শোকাভিভূত। বাংলা ও হিন্দি নাটকে তাঁর স্থান পূরণ হবার নয়।