নাটক শেষ। এক খুদে দর্শক নাটকের নির্দেশককে খুঁজছেন। তার খুব জানার ইচ্ছা, জয়সিংহ চরিত্রে যে অভিনয় করল, সে কি মারা যাওয়ার সময় শ্বাস নিতে পেরেছে? নাকি সত্যি সত্যিই মারা গেছে? তাঁকে না দেখা পর্যন্ত ওই খুদে দর্শকের মনে শান্তি নেই। তার মা ছুটলেন নাটকের নির্দেশকের কাছে। গিয়ে বললেন খুদে দর্শকের আবদার। নির্দেশক জয়সিংহ চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতার সঙ্গে ওই দর্শককে দেখা করিয়ে দিলেন। শান্ত হলো সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডলে বছর শুরু হলো নাটক দিয়ে। ইংরেজি নববর্ষের প্রথম দিন নাটমণ্ডলে নেমে এলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সন্ধ্যায় তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘বিসর্জন’ মঞ্চে নিয়ে এল বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষ ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থীরা। ১ থেকে ৫ জানুয়ারি নিয়মিত প্রদর্শনী হয়েছে এ নাটকের।
রক্ত নয়, প্রেম ও ভালোবাসা দিয়ে মনুষ্যত্বের জয়গান এই নাটকের বিষয়বস্তু, এটা জানা অনেকেরই। তবু কেন এই নাটক নিয়ে আলোচনা, তার কারণ আছে বৈকি। সাধারণত এই শহরে বেশির ভাগ নাটকই প্রসেনিয়াম মঞ্চে দেখতে অভ্যস্ত দর্শক। এবার রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন এল একবারে দেশি ধাঁচে। চিরচেনা গ্রাম–গঞ্জের যাত্রাপালার আদলে নাটকটির নির্দেশনা দেওয়া হলো। কেন? তার দায় নিয়ে শোনা গেল নাটকের শেষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আশিকুর রহমান জানালেন, অভিযোগ আছে, শুধু বিদেশি ভাষার নাটকই করা হয় এখানে। তাই বছরের শুরুটা হলো বাংলা নাটক দিয়ে।
শুধু তা–ই নয়, একেবারে দেশি ঢঙে। দায়মোচনের পাশাপাশি, বাংলা নাটক পেল একটি অনিন্দ্যসুন্দর প্রযোজনা, যার পরিবেশনের রীতি একেবারেই দেশের কথা কয়।
নাটকের সূচনা, অভিনয়শিল্পীদের সংলাপ প্রক্ষেপণ, মঞ্চ ও আলোকসম্পাত—সবকিছুতেই যাত্রার আদল চোখে পড়ে। মেলোড্রামাটিক অতি অভিনয়, উচ্চস্বরে সংলাপ বলার প্রক্রিয়া, প্রম্পট করা—সবকিছুই যেন মনে করিয়ে দেয়, যাত্রা হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও নাটকের মধ্য দিয়ে তার অভিনয়রীতি বেঁচে থাকবে আজীবন। এই আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে ধন্যবাদ দিতে হয়। যাত্রার শিল্পীদের থাকে দীর্ঘদিনের অনুশীলন। হুট করেই নাট্যকলার তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীর ওই অভিনয়ের ধরন ধরতে পারা মুশকিল বটে। তাই এই নাট্যপ্রযোজনা তৈরিতে সহযোগিতা করেছে একাডেমি। শুধু তা–ই নয়, প্রযোজনায় বেশ কয়েকজন যাত্রাশিল্পীর অংশগ্রহণও ছিল উল্লেখ করার মতো।
‘বিসর্জন’ নাটকের কাহিনি প্রায় সবারই জানা। ছোট্ট ছাগশিশু বলি দেওয়া হয়েছে। রাজা গোবিন্দমাণিক্যকে অভিযোগ জানায় অপর্ণা। রাজা রাজ্যে ঘোষণা করে দেন, বলি দেওয়া নিষিদ্ধ। খেপে যান ত্রিপুরা রাজ্যের পুরোহিত রঘুপতি। এত বড় সাহস! রাজার স্পর্ধা আসে মন্দিরেরও দ্বারে। বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। শুরু হয় রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তিনি ষড়যন্ত্রের গুটি হিসেবে নিয়ে নেন বেশ কিছু সুযোগ। রানি গুণবতীর সন্তান না হওয়া এবং রাজার ছোট ভাই নক্ষত্রকে রাজা হওয়ার কুমন্ত্রণা রঘুপতি চাল হিসেবে নেন। কিন্তু সব ষড়যন্ত্রই যখন রাজার বিরুদ্ধে নস্যাৎ হয়ে যায়, রঘুপতি নেন এক ভয়ংকর পরিকল্পনা। তিনি তাঁর মন্দিরে বেড়ে ওঠা পালিত পুত্র রাজসেবক জয়সিংহকে রাজরক্ত এনে দিতে বলেন। জয়সিংহ রাজা গোবিন্দমাণিক্যের বড় প্রিয়। একদিকে বলি নিষিদ্ধ, অন্যদিকে গুরুর আদেশ। একদিকে প্রেম, অন্যদিকে প্রথা। কোন পথে হাঁটবেন তিনি? শেষমেশ নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেন তিনি। কারণ, তাঁর নিজের রক্তেও যে বইছে রাজরক্ত।
ত্রিপুরা রাজ্যের রাজা গোবিন্দমাণিক্যের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নিজের কল্পনার মিশেলে প্রেম ও প্রথার দ্বন্দ্ব নিয়ে এই নাট্যকাব্য লিখেছিলেন কবিগুরু, যা কালক্রমে এখনো সমসাময়িক হয়ে ওঠে বারবার। যখন ধর্মের নামে এখনো রক্ত ঝরে।
সন্ধ্যায় এমনই মানবপ্রেমের জয়ধ্বনি গাওয়া হলো নাটমণ্ডলে। যাত্রাপালার ঢঙে নবীন এই শিক্ষার্থীদের নাটকটির উপস্থাপন চাট্টিখানি কথা নয়। তাঁদের অভিনয়ের খুঁটিনাটি না ধরে বরং উৎসাহ দেওয়াই উত্তম।
কারণ যাত্রা শুরু কেবল, সামনে আছে অসীম শেখার সময়। সেই দিক থেকে বলা যায়, অভিনয় ও যাত্রাপালা রীতি—এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে কোথায় যেন প্রাণ হারিয়েছে মাঝেমধ্যে। সংলাপ প্রক্ষেপণে যাত্রার ঢঙের উচ্চস্বর যেমন চাই, তেমনি শান্ত ও পরিমিত অভিনয়ও চাই। অধিক ঝনঝনানির থেকে একটা শান্ত আবহে পিন পতনের শব্দও অনেক সময় মনকে নাড়িয়ে দেয়। এই নাটকে প্রচুর ও দীর্ঘ সংলাপ। অস্পষ্ট হলে দর্শক বুঝবেন কী করে? দীর্ঘ সংলাপের সবটুকুই স্পষ্ট করে বলা চাই। কিংবা গান ও কোরিওগ্রাফিতে একটু এদিক–ওদিক হলেই সুতোটা কেটে যায়। এই তো, ছোট ছোট জায়গা, আরেকটু যত্ন নিলেই একটা অসাধারণ প্রযোজনা হয়ে উঠবে।
সবশেষ বলা যায়, বছরের শুরুটা মানবতার জয়গান দিয়ে শুরু হয়েছে মঞ্চে। এই ধারা বহাল থাকুক। প্রেমের জয় হোক সারা বছর। এমন একটা শুরুর জন্য ধন্যবাদ পেতেই পারেন নির্দেশক তানভীর নাহিদ খান এবং তাঁর তরুণ অভিনয়শিল্পীরা।