গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ছিল নাট্যানুরাগী দর্শকের দারুণ উপস্থিতি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁরা এসেছেন, কেননা গতকাল দুই মঞ্চে দুটি নতুন নাটকের উদ্বোধন হয়েছে। রাজধানীর বেইলি রোডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় ‘হ্যাপি ডেজ’ নাটকের দুটি প্রদর্শনী। এক দিনে দুটি নতুন নাটক আর নাটক দেখতে আসা দর্শকের আগ্রহ দেখে মনে হলো, নাট্যাঙ্গনে বসন্ত উঁকি দিচ্ছে যেন। সাধারণত শীত শেষে বসন্তেই নাটকপাড়া জমে বেশি।
নতুন নাটক ‘রেনুলতা’র উদ্বোধন
তারুণ্যদীপ্ত ও প্রশংসিত নাট্যসংগঠন ইউনিভার্সেল থিয়েটার। ইতিমধ্যে তাদের কিছু প্রযোজনা বিপুল প্রশংসা পেয়েছে নাট্যমোদীদের। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ এ দলটি মঞ্চে এনেছে জঙ্গিবাদবিরোধী নতুন নাটক ‘রেনুলতা’। জঙ্গিবাদ শুধু বাংলাদেশে নয়, ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে অনেক দেশেই। জঙ্গিদের হাতে বারবার প্রকম্পিত হয়েছে, সাধারণ মানুষের কান্নার নোনা স্রোতে ভেসেছে বাংলাদেশ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় ও জাতিগত সহিংসতা, উগ্রবাদ ও তার নৃশংসতার বিরুদ্ধে এ নাটকে উঠেছে মানবতার জয়গান।
গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত হয় নাটকটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী। নাটকটি লিখেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন আবুল হোসেন খোকন।
‘রেনুলতা’ নাটকের প্রথম প্রদর্শনী দেখতে গতকাল ভিড় করেছিলেন অনেক নাট্যমোদী। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় শুরু হয় নাটক। সময়োপযোগী এ নাটকে যেমন ছিল প্রেম ও দাম্পত্য জীবনের কথা, তেমনই ছিল নীরবে জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয়াবহ চিত্র। দর্শক–শ্রোতাদের নাটকটি দেখতে দেখতে মনে পড়বে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত নানা জঙ্গি হামলার কথা।
বলা হয় ‘পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়’। যুগ যুগ ধরে চলে আসা অমোঘ এই বিধানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে নাটকে মানুষ ও ধর্মের এক নির্মোহ বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। নাটকটির প্রধান চরিত্র রেনুলতা একজন অভিনেত্রী। নাটকের শুরুতেই দেখা যায় এ অভিনেত্রীকে জেরা করছে গোয়েন্দা পুলিশ। জানতে চাচ্ছে ঘটনার গোপন সূত্র। তখনই স্মৃতিচারণে উঠে আসে তাঁর জীবন আর সংসারের মর্মান্তিক ঘটনা। উঠে আসে জঙ্গিবাদের ভয়াল রূপ। বীভৎস এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে ফেরেন রেনুলতা। একদিন নাটক চলাকালে মঞ্চে আক্রমণ করে এক জঙ্গি দল। সেখানে তিনি দেখতে পান তাঁর হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে। জঙ্গি দলে যোগ দিয়ে তাঁর স্বামী জাহিদ হয়ে যান জিহাদ জাঈদী। তীব্র ঘৃণায় উন্মাদ হয়ে যান রেনুলতা। তাঁকেই জিম্মি করেন জাহিদ। সঙ্গে নিয়ে নেন নাটকের নির্দেশক হিমেশ চন্দ্রকে। এরপর সরকারের সঙ্গে চলতে থাকে দর-কষাকষি। একপর্যায়ে বোমা বিস্ফোরণে প্রাণ হারায় সব জঙ্গি। সন্দেহভাজন হিসেবে ইন্সপেক্টর আরমানের জেরার মুখে পড়েন রেনুলতা। এভাবেই এগিয়ে যায় নাটকের কাহিনি।
ইউনিভার্সেল থিয়েটারের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক আজিজুল পারভেজ বলেন, পবিত্র ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে জিহাদিরা সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। সারা বিশ্বে নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, পুরো দুনিয়া আজ এই মরণব্যাধির ভয়ে আতঙ্কিত। অথচ যারা এর মদদদাতা, যারা পেছনে বসে এসবের কলকাঠি নাড়ছে, তারা যুগের পর যুগ থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ধর্মের নামে নিরীহ মানুষ হত্যা করে কাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে তারা? নাটকের মধ্য দিয়ে সেই প্রশ্নের গভীরে ঢোকার ও সন্ত্রাসবাদের শিকড় উপড়ে ফেলার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে।
নাটকে রেনুলতা চরিত্রে সুমী ইসলাম, জাহিদ ওরফে জিহাদ জাঈদী চরিত্রে শওকত আলী মনসুর, ইন্সপেক্টর আরমান চরিত্রে আবুল হোসেন খোকন ও হিমেশ চন্দ্র চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাজহারুল হক। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন অধরা, কানিজ সুলতানা, মিরাজ আহমেদ, শাহরিয়ার খান সাদ, রুবেল চৌধুরী ও মোহাম্মদ রাসেল।
স্টুডিও থিয়েটারে ‘রং লেগেছে’
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটারে গতকাল দর্শক দেখেছেন নাট্যদল পালাকারের নতুন নাটক রোমান্টিক কমেডি প্রযোজনা ‘রং লেগেছে’। ১৮৯০ সালের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতার মঞ্চে ‘পৌরাণিক পঞ্চরং’ শিরোনামে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ করে নাট্যদল দি রয়েল বেঙ্গল থিয়েটার। সেই মঞ্চায়নের ১৩০ বছর পর নতুন রূপে নাটকটি মঞ্চে এনেছে পালাকার। নাটকটির নাট্য নবায়নের পাশাপাশি পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন আমিনুর রহমান। গতকাল বিকেল পাঁচটায় এবং সন্ধ্যা সাতটায় পরপর দুটি প্রদর্শনী হয় ‘রং লেগেছে’ নাটকের। আজ শনিবার একই সূচিতে নাটকের তৃতীয় ও চতুর্থ প্রদর্শনী হবে নাট্যশালার স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে।
‘হ্যাপি ডেজ’ নাটকের জোড়া প্রদর্শনী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সাবেক ছাত্র সুমন এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা সংকটজনক। তাঁর চিকিৎসা সহায়তায় গতকাল বেইলি রোডের বাংলাদেশ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘হ্যাপি ডেজ’।
ফরাসি দূতাবাস প্রযোজিত মণিপুরি থিয়েটার ও হৃৎ মঞ্চ পরিবেশিত স্যামুয়েল বেকেটের লেখা ‘হ্যাপি ডেজ’ নাটকে অভিনয় করেছেন জ্যোতি সিনহা। নির্দেশনা দিয়েছেন শুভাশিস সিনহা।