'ফাউস্ট' অথবা অন্য কেউ' নাটকের দৃশ্য
'ফাউস্ট' অথবা অন্য কেউ' নাটকের দৃশ্য

নতুন স্বাভাবিকে যা ভাবছেন থিয়েটারকর্মীরা

ঠিক সন্ধা নামার আগে। ছোট্ট প্রবেশপথ। চার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে চোখে পড়ে পাঁচটি প্রদীপ, মিটিমিটি জ্বলছে। মৃদু–মন্থরে আসছে মন্দিরার ধ্বনি। দর্শকের শরীরের উত্তাপ পরিমাপ করে নিলেন একজন নাট্যকর্মী। হাতে মাখা হলো স্যানিটাইজার। কিছুটা এগিয়ে গেলে মন্দিরার ধ্বনি হলো জোরালো। এর অর্থ—প্রবেশে বাধা নেই আর।

প্রাচ্যনাট আয়োজিত উঠান নাটকের মেলা মহলা মগন–এর শেষ দিনের কথা। আলো–আঁধারিতে আচ্ছন্ন মিলনায়তন। কুশীলবদের অবয়ব ও কণ্ঠে নাটকের আবহ। রাজধানীর কাঁটাবনে নিজেদের মহড়াকক্ষকেই এই নতুন স্বাভাবিকের মঞ্চ করে নিয়েছেন তাঁরা। আসনসংখ্যা মাত্র ২০, পরিপূর্ণ।

নভেম্বরেও আয়োজিত হতে পারে আরেকটি নাট্যমেলা

জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের 'ফাউস্ট' অবলম্বনে ছিল তাদের শেষ দিনের নাট্য প্রদর্শনী। হুবহু নয়, এই সময়ের তরুণদের চোখে নির্মিত বলে তাদের নাটকের নাম রাখা হয়েছে 'ফাউস্ট অথবা অন্য কেউ'। পুঁজিবাদ কী করে মানুষকে দিন দিন ভোগবাদী বানিয়ে ফেলে, এরপর সেই ভোগ আর বিলাসের মোহে সে হারিয়ে যায় পাপের অতলগহ্বরে—এই নাটকের নির্যাস তাই। কতটা মনে লেগেছে দর্শকের? তার উত্তর পাওয়া গেছে নাটকের মাঝেমাঝেই দর্শকের হাসির রোল দেখে। নাটক শেষে করতালিও বুঝিয়ে দেয় নাটকের শক্তি।

করোনায় সবকিছু এলোমেলো হলেও থিয়েটারকর্মীরা খুঁজে নিয়েছেন নিজেদের পথ। কখনো নিজেদের থাকার জায়গা হয়ে গেছে পারফরম্যান্স স্পেস, যা দেখা গেছে অনলাইনে। আর প্রাচ্যনাটের কর্মীরা নিজেদের মহড়াকক্ষকে বানিয়েছেন প্রদর্শনীর স্পেস কিংবা মিলনায়তন।

করোনায় সবকিছু এলোমেলো হলেও থিয়েটারকর্মীরা খুঁজে নিয়েছেন নিজেদের পথ।
করোনায় সবকিছু এলোমেলো হলেও থিয়েটারকর্মীরা খুঁজে নিয়েছেন নিজেদের পথ। কখনো নিজেদের থাকার জায়গা হয়ে গেছে পারফরম্যান্স স্পেস, যা দেখা গেছে অনলাইনে। আর প্রাচ্যনাটের কর্মীরা নিজেদের মহড়াকক্ষকে বানিয়েছেন প্রদর্শনীর স্পেস কিংবা মিলনায়তন।

করোনার প্রভাবে প্রায় ছয় মাস অভিনয়শিল্পীদের মুখোমুখী হতে পারেননি মঞ্চনাটকের দর্শকেরা। গত আগস্টের শেষ দিকে দু–একটি প্রদর্শনী হতে শুরু করে। এরপরই সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে প্রাচ্যনাট আয়োজন করে মহলা মগন উঠান নাটকের মেলা–২০২০। এই মেলা শেষে কী অর্জন আয়োজকদের। প্রাচ্যনাটের মুখ্য সম্পাদক কাজী তৌফিকুল ইসলাম নাটক শেষে বলছিলেন এভাবে, ‘মঞ্চনাটক অভিনেতা ও দর্শক উভয়ের অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন মিলনায়তন বন্ধ থাকায় অভিনেতারা যেমন অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তেমনি দর্শকেরাও। মহড়ার মাধ্যমে অভিনেতারা নিজেদের অভ্যস্ততায় ফিরতে পারেন। কিন্তু দর্শকদেরও ফেরাতে হবে আবার মিলনায়তনে। সে জন্য এমন আয়োজনের বিকল্প নেই।’

কাজী তৌফিকুল ইসলাম জানান, মাসব্যাপী শুক্র ও শনিবার ছিল এই আয়োজন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ২০টি আসন নির্ধারণ করা হয়। দর্শকের প্রতিক্রিয়াও ছিল আশাব্যঞ্জক। প্রতিদিনই আসন পূর্ণ ছিল। অক্টোবর মাসটি তাঁরা বিরতি নিচ্ছেন। এরপর নভেম্বর মাসে আবার একটি নাটকের মেলা নিয়ে নিজেদের মহড়াকক্ষেই হাজির হবে প্রাচ্যনাট।

প্রায় ছয় মাস অভিনয়শিল্পীদের মুখোমুখী হতে পারেননি মঞ্চনাটকের দর্শকেরা।

এই মহড়াকক্ষ কি ধীরে ধীরে মিলনায়তনে রূপ নেবে? এমন প্রশ্নে কাজী তৌফিকুল ইসলাম জানান, তাঁদের অনেক দিনের পরিকল্পনা প্রাচ্যনাট স্টুডিও থিয়েটার তৈরির। এরই একটি প্রচেষ্টা এই আয়োজন।

নাটক প্রদর্শনীর পরেই দ্বিতীয় পর্বে ‘মনঃসামাজিক বিশ্লেষণ ও বর্তমান’ নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনার আয়োজন করা হয় এই নাট্যমেলায়। কারণ নাট্যমেলার স্লোগানই ছিল ‘অবসাদ বিরুদ্ধস্রোত’। করোনার সংক্রমণ এখনো শেষ হয়ে যায়নি। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে প্রাচ্যনাট। দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য সাইফুল জার্নাল জানান, স্বাস্থ্যবিধি গুরুত্বসহকারে মেনেই চলবে তাদের কার্যক্রম। এমনকি নাটকে অভিনেতা কমিয়ে নিরীক্ষামূলক প্রযোজনার পরিকল্পনাও আছে তাঁদের।

প্রাচ্যনাট নাটকের দলের অনেক দিনের পরিকল্পনা প্রাচ্যনাট স্টুডিও থিয়েটার তৈরির। এরই একটি প্রচেষ্টা এই আয়োজন।

প্রাচ্যনাট শুরু করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা খুলবে ২৩ অক্টোবর। প্রতি শুক্র ও শনিবার এবং সরকারি ছুটির দিনগুলোতে নাটকের প্রদর্শনী হবে সেখানে। এই দীর্ঘদিনের থিয়েটারচর্চার বিরতিতে অনেক দলেরই পুনরায় শুরু করতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তাই নাটক প্রদর্শনীতে সহযোগিতা করা হবে দলগুলোকে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের মহাসচিব কামাল বায়েজীদ জানান, অক্টোবর থেকে ছয় মাস দলগুলোর জন্য মিলনায়তন ভাড়া এবং মহড়া কক্ষের ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে।

’শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ নাটকের দৃশ্য

ঢাকার অদূরে দনিয়া স্টুডিও থিয়েটার ৯ ও ১০ অক্টোবর আয়োজন করছে দুই দিনের নাট্যমেলা। সূত্র জানিয়েছে, সীমিত পরিসরে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই নাট্যমেলায় আটটি দল তাদের নাটক প্রদর্শন করবে। দেখা যাবে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়ের 'শ্রাবণ ট্র্যাজেডি' (অংশবিশেষ), শৌখিন থিয়েটারের 'প্রভাত ফিরে এসো', মৈত্রী থিয়েটারের 'চা অথবা কফি', সায়াহ্নিকা থিয়েটারের 'বসন্তের কুটুম', কথক থিয়েটারের 'নিঃশ্বাস', চন্দ্রকলা থিয়েটারের 'শেখ সাদী' (অংশবিশেষ), নাট্যযোদ্ধার 'অসমাপ্ত' এবং শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের 'বীরাঙ্গনার বয়ান'। এই নাট্যমেলায় সহযোগিতা করছে দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট ও দনিয়া পাঠাগার।

করোনায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে আবার চাঙা হচ্ছে নাট্যাঙ্গন। অভিনেতা ও দর্শক—উভয়ের জন্যই এ এক সুখবর। তবে সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষেরা সবার আগে গুরুত্ব দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টিকে।